প্রকৃত বৈষ্ণব কে?

 


            ❀❈❀প্রকৃত বৈষ্ণব কে?❀❈❀

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ

      ❀❈দুষ্ট মন তুমি কিসের বৈষ্ণব?❈❀


❈❀━┉┈হে দুষ্ট মন! তুমি নিজেকে একজন বৈষ্ণব মনে কর, কিন্তু তুমি কি সত্যিই বৈষ্ণব?নির্জন ঘরে বসে তুমি হরিনাম কর, কিন্তু মনে প্রতিষ্ঠার আশা, তাহলে তোমার হরিনাম করা কপটতা মাত্র, তাহলে তুমি কিসের বৈষ্ণব?()

 

❈❀━┉┈হে মন! তুমি কি জানো না যে, জড় জাগতিক প্রতিষ্টা-শুকরের বিষ্ঠাসম তা মায়ারই সম্পদ? সারাদিন রাত ধরে তুমি কনক-কামিনীর কথা ভাব, কিন্তু এই অনিত্য বস্তু প্রাপ্তির জন্য ভেবে কি লাভ বল?()

 

❈❀━┉┈হে দুষ্ট মন! তুমি যে কনকের কথা ভাব, তা দুর্ভোগের মূল কারণ, সেই কনকাদি সম্পদ দিয়ে তুমি রাধামাধবকে সেবা কর, তাহলে তা সার্থক হবে! কামিনীর যে কাম, তা তোমার ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য নয়, তা একমাত্র কৃষ্ণেন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্যই (কারণ প্রত্যেকের হৃদয়ে কামরূপে স্বয়ং কৃষ্ণই বাস করে, তা সুসন্তান জন্ম হেতু অর্থাৎ কৃষ্ণ-প্রীত্যার্থে কৃষ্ণভক্ত সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই তিনি কামরূপে বিরাজমান, আত্মেন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য নয়()

 

❈❀━┉┈হে মন! প্রতিষ্ঠা নামক যে বৃক্ষ তা আসলে জড় মায়া-মরুভূমির ন্যায়, তা অনিত্য। প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় রাবন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে ধ্বংস হল, প্রতিষ্ঠা পেল কি? যদি সত্যিই প্রতিষ্ঠা পেতে চাও তাহলে  কৃষ্ণভজন করে বৈষ্ণব হও,নিষ্ঠার সঙ্গে ভজনসাধন করো, তাহলে তুমি চিরন্তন, নিত্য, শাশ্বত প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারবে। আর কৃষ্ণভজন না করলে রৌরব নামক নরকে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।()

 

❈❀━┉┈হে মন! হরিভক্ত বৈষ্ণবগণের প্রতি বিদ্বেষ করে প্রতিষ্ঠালাভের আশা কেবলই ক্লেশমাত্র, তাহলে কেন তুমি জড়-জাগতিক প্রতিষ্ঠায় এত গৌরব কর? প্রকৃত প্রতিষ্ঠা যদি তুমি চাও তাহলে সাধু-গুরু-বৈষ্ণবের নিকটে যাও, সেখানে নিত্য প্রতিষ্ঠার আশা আছে, তা কখনোই "অনিত্য সম্পদ" নয়।()

 

❈❀━┉┈হে মন! যখন তোমার কৃষ্ণের সঙ্গে গভীর সম্বন্ধ হবে, সেই সম্বন্ধ একেবারেই মায়াগন্ধহীন এবং তা কখনোই জড়-জাগতিক আত্মীয় সম্বন্ধের ন্যায় কপটতা নয়। নির্জ্জনতা(সকামী সাধকের নির্জন  সাধন) প্রতিষ্ঠা নামক চণ্ডালী উভয়কেই মায়িক-রৌরব নরকের মতোই মনে করবে।()

 

❈❀━┉┈হে মন! হরিনাম সংকীর্তন ছেড়ে যদি প্রতিষ্ঠা নামক প্রসাধনীকে গায়ে মাখি, তাহলে সেইরকম গৌরবের অনুসন্ধান করে কি লাভ বল? শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ কখনোই ভাবের ঘরে চুরি করতেন না, একথা সবসময়ই মনে রেখো।()

 

❈❀━┉┈হে দুষ্ট মন! তোমার যে প্রতিষ্ঠা, তা শুকরের বিষ্ঠাসম, সেই বিষ্ঠার সঙ্গে সমতুল্য কখনোই কিছু মানা উচিত নয়!(শুকরের বিষ্ঠাসম জাগতিক প্রতিষ্ঠা আর বৈষ্ণবীয় কৃষ্ণভজনে নিত্য শাশ্বত প্রতিষ্ঠা কখনোই সমান নয়) সংকীর্তনরূপ পরম সম্পদ ছেড়ে মাৎসর্যপরায়নের বশীভূত হয়ে তুমি জড়রসে মজেছো?()

 

❈❀━┉┈হে দুষ্ট মন! সুতরাং তুমি ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রতিষ্ঠার আশায় নির্জ্জনে ভজন করছ, আর ছলনার দ্বারা কুযোগী-বৈভবকে প্রচার করছ!(যা গোস্বামীগণের সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধ, তা কুযোগী-সম্পদসম) কলিযুগ পাবনাবতারী শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু, শ্রীল সনাতন গোস্বামীপাদকে যে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন তা পরম যত্নের সঙ্গে চিন্তা কর।()

 

❈❀━┉┈হে মন! শ্রীল সনাতন গোস্বামী শিক্ষার যে চিন্ময় বাণী তা কখনোই ভুলে যেওনা। সর্বদাই সবখানেই উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম সংকীর্তন কর। ফল্গু-বৈরাগ্য যুক্ত-বৈরাগ্য, বদ্ধজীব আর মুক্তজীব---এগুলোকে কখনোই  একাকার ভেবে বসো না।(১০)

 

❈❀━┉┈হে মন! যাঁর হৃদয় থেকে কনক-কামিনী, জাগতিক প্রতিষ্ঠারূপ বাঘিনী ছেড়ে চলে গেছে সেই প্রকৃত বৈষ্ণব। যিনি সবকিছুতে অনাসক্ত, তিনিই শুদ্ধ ভক্ত, তাঁর কাছে এই সংসাররূপ মায়া পরাজয় স্বীকার করে।(১১)

 

❈❀━┉┈হে মন!কি আর বলব! যিনি বিষয়ের প্রতি সমস্ত আসক্তি পরিত্যাগ 'রে, কৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত 'য়ে, সমস্ত বিষয় সম্পদকে মাধবের চরণে সমর্পন 'রে যথাযোগ্যভাবে মাধবের সেবায় বিষয়ভোগ করেন, সেখানে কোনও ভবরোগ থাকে না!(১২)

 

❈❀━┉┈হে মন! যিনি যুক্ত বৈরাগ্য লাভ 'রে বিষয়কে কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত করেছেন,তিনিই পরম সৌভাগ্যবান এবং সেই জড়সম্পদই কৃষ্ণসেবায় কৃষ্ণেরই সম্পদ হয়ে যায়। কিন্তু যিনি প্রতিষ্ঠাদির আশায় কীর্তন করেন তার সম্পদ কেবল কপটতামাত্র।(১৩)

 

❈❀━┉┈হে মন! যিনি জড় বিষয়-সম্পদকামী, যিনি ভোগবিলাসকামী, এই দুই ধরণের ব্যক্তির সঙ্গ ত্যাগ কর, কারণ এই দুই প্রকার ব্যক্তিই অবৈষ্ণব। যিনি কৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েছেন, যার বিষয় কৃষ্ণসেবার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েছে, তা অপ্রাকৃত, তা কখনোই জড়জাগতিক নয়।(১৪)

 

❈❀━┉┈হে মন! যারা মায়াবাদী, তারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই মানে না। কিন্তু নিজেদের মুক্ত আত্মা অভিমানে বৈষ্ণবগণকে নিন্দা করে। তোমার একমাত্র বাঞ্ছা হবে--তুমি যেন বৈষ্ণবের দাসানুদাস হতে পার। নির্জনে বসে সকামযুক্ত হরিনাম করে কেন তাঁকে ডাকছো?(১৫)

 

❈❀━┉┈হে মন! যিনি 'ফল্গু-বৈরাগী' তিনি নিজেকে ত্যাগী বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু ফল্গু নদীর বালির নিচে জলের ন্যায় হৃদয়ে রয়েছে বিষয় বাসনা। তিনি কখনোই বৈষ্ণব হতে পারেন না। তিনি যদি হরিনাম সংকীর্তন বাদ দিয়ে, অন্তরে বিষয়বাসনা নিয়ে নির্জনে বসে যোগ ধ্যান করেন, সেই ফল্গু বৈভবে কোনও লাভ নেই।(১৬)

 

❈❀━┉┈হে মন! ভোগবাসনা, লাভ, পূজা, প্রতিষ্ঠার আশা পরিত্যাগ 'রে, রাধাদাস্য অভিমানে ভজন কর। হরিনাম সংকীর্তনের গৌরব হল কৃষ্ণপ্রেম,প্রতিষ্ঠাশা নয়। রাধারাণীই একমাত্র তোমার নিত্যজন, রাধারাণীই একমাত্র তোমার সাধন ভজন, রাধাদাসীত্বেই তোমার অভিমান, কিন্তু সেই সাধন ছেড়ে তুমি নির্জনে বসে ধ্যান করছ? এটা কপটতা ছাড়া কিছুই নয়।(১৭)

 

❈❀━┉┈হে মন! ব্রজবাসীগণ প্রচারক-ধন, তারা মৃত নয়, তাদের প্রাণ আছে, কারণ তারা কৃষ্ণকথা প্রচার করেন,তাদের প্রতিষ্ঠাশা, জড় জাগতিক প্রতিষ্ঠাশা নয়, সারা পৃথিবীতে যত নগরাদি গ্রাম আছে সর্বত্রই কৃষ্ণনাম প্রচার করাই ব্রজবাসী(নবদ্বীপ,বৃন্দাবন)-কৃষ্ণভক্তের কর্তব্য, এটা প্রতিষ্ঠাশা নয়, কৃষ্ণকথা কৃষ্ণনাম প্রত্যেক জীবের মাঝে প্রদান করাই প্রতিষ্ঠাশাহীন প্রাণবন্ত প্রচার।(১৮)

 

❈❀━┉┈শ্রীদয়িত দাস(প্রভুপাদ) সবার কাছে হরিনাম সংকীর্তনই প্রত্যাশা করেন! সবাই উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম কর। হরিনাম সংকীর্তন প্রভাবে ধীরে ধীরে তোমার লীলাস্মরণ স্বভাবে পরিণত হবে! তারপর তোমার  হরিনামের প্রভাবে স্মরণ স্বভাবে নির্জনে ভজন সাধন সম্ভব হবে।(১৯)

                   


     বৈষ্ণব কে..?

শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর রচিত

***********

       দুষ্ট মন ! তুমি কিসের বৈষ্ণব ?

       প্রতিষ্ঠার তরে, নির্জনের ঘরে,

       তব 'হরিনাম' কেবল 'কৈতব' ॥১॥

       জড়ের প্রতিষ্ঠা, শূকরের বিষ্ঠা

        জান না কি তাহা 'মায়ার বৈভব' ?_

       কনক-কামিনী, দিবস-যামিনী,

       ভাবিয়া কি কাজ, অনিত্য সে সব ॥২॥

       তোমার কনক, ভোগের জনক,

       কনকের দ্বারে সেবহ 'মাধব'

        কামিনীর কাম, নহে তব ধাম,

       তাহার মালিক কেবল 'যাদব'॥৩॥

        প্রতিষ্ঠাশা-তরু, জড়-মায়া-মরু,

      না পেল 'রাবণ' যুঝিয়া 'রাঘব'

      বৈষ্ণবী প্রতিষ্ঠা, তাতে কর নিষ্ঠা,

      তাহা না ভজিলে লভিবে রৌরব॥৪॥

      হরিজন-দ্বেষ প্রতিষ্ঠাশা-ক্লেশ,

      কর কেন তবে তাহার গৌরব।

       বৈষ্ণবের পাছে, প্রতিষ্ঠাশা আছে,

       তা'তে, কভু নহে 'অনিত্য-বৈভব' ॥৫॥

      সে হরি-সম্বন্ধ, শূন্য-মায়াগন্ধ,

      তাহা কভু নয় 'জড়ের কৈতব'

      প্রতিষ্ঠা-চণ্ডালী, নির্জনতা-জালি,

      উভয়ে জানিহ মায়িক রৌরব ॥৬॥

      'কীর্তন ছাড়িব, প্রতিষ্ঠা মাখিব',

      কি কাজ ঢুড়িয়া তাদৃশ গৌরব *

      মাধবেন্দ্র পুরী, ভাব-ঘরে চুরি,*

      না করিল কভু সদাই জানব ॥৭॥

      তোমার প্রতিষ্ঠা,--- 'শূকরের বিষ্ঠা',

     তার-সহ সম কভু না মানব

      মৎসরতা-বশে, তুমি জড়রসে,

      মজেছ ছাড়িয়া কীর্তন-সৌষ্ঠব॥৮॥

        তাই দুষ্ট মন, 'নির্জন ভজন',

      প্রচারিছ ছলে 'কুযোগী-বৈভব'

      প্রভু সনাতনে, পরম যতনে,

        শিক্ষা দিল যাহা, চিন্ত সেই সব॥৯॥

       সেই দু'টি কথা, ভুল' না সর্বথা,

      উচ্চৈঃস্বরে কর 'হরিনাম-রব'

      'ফল্গু', আর 'যুক্ত', 'বদ্ধ' আর 'মুক্ত',

      কভু না ভাবিহ, 'একাকার' সব ॥১০॥

      'কনক-কামিনী', 'প্রতিষ্ঠা-বাঘিনী',

      ছাড়িয়াছে যারে, সেই ' বৈষ্ণব

      সেই 'অনাসক্ত', সেই 'শুদ্ধ ভক্ত',

      সংসার তথা পায় পরাভব ॥১১॥

      যথাযোগ্য ভোগ, নাহি তথা রোগ,

     'অনাসক্ত' সেই, কি আর কহব

      'আসক্তি-রহিত', 'সম্বন্ধ-সহিত',

      বিষয়সমূহ সকলি 'মাধব' ॥১২॥

      সে 'যুক্ত-বৈরাগ্য', তাহা ' সৌভাগ্য,

      তাহাই জড়েতে হরির বৈভব।

      কীর্তনে যাহার, 'প্রতিষ্ঠা-সম্ভার',

      তাহার সম্পত্তি কেবল 'কৈতব'॥১৩॥

     বিষয়-মুমুক্ষু”, ভোগের বুভুক্ষু,”

      দুয়ে ত্যজ মনদুই “অবৈষ্ণব

       কৃষ্ণের সম্বন্ধ”, অপ্রাকৃত-স্কন্ধ,

     কভু নহে তাহা জড়ের সম্ভব॥১৪॥

     মায়াবাদী জন”, কৃষ্ণে তর মন,

     মুক্ত অভিমানে সে নিন্দে বৈষ্ণব।

      বৈষ্ণবের দাসতব ভক্তি-আশ,

      কেন বা ডাকিছ নির্জ্জন-আহব॥১৫॥

      যে “ফল্গু-বৈরাগী”, কহে নিজে “ত্যাগী”,

      সে না পারে কভু হৈতে “বৈষ্ণব

      হরিপদ ছাড়ি’, “নির্জ্জনতা বাড়ি

      লভিয়া কি ফল, “ফল্গু” সে বৈভব॥১৬॥

      রাধা দাস্যে রহি’, ছাড়ি “ভোগ-অহি,”

      প্রতিষ্ঠাশা” নহে “কীর্ত্তন-গৌরব

      রাধা-নিত্যজন”, তাহা ছাড়ি’ মন,

      কেন বা নির্জ্জন-ভজন-কৈতব॥১৭॥

      ব্রজবাসিগণপ্রচারক-ধন,

      প্রতিষ্ঠা-ভিক্ষুক তারা নহে “শব

      প্রাণ অছে তাঁরসেহেতু প্রচার,

      প্রতিষ্ঠাশা হীন -“কৃষ্ণগাথা” সব॥১৮॥

     শ্রীদয়িতদাসকীর্ত্তনতে আশ,

      কর উচ্চৈঃস্বরে “হরিনাম-রব

      কীর্ত্তন-প্রভাবেস্মরণ স্বভাবে,

      সে কালে ভজন-নির্জ্জন সম্ভব॥১৯॥


কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.