কোনটি কাম আর কোনটি প্রেম বিদগ্ধ শিরোমনি
কোনটি কাম আর কোনটি প্রেম বিদগ্ধ শিরোমনি শ্রীকৃষ্ণ তা সহজেই বুঝতে পারেন। নিজ ইন্দ্রিয় প্রীতির তর্পণের নাম কাম। আর আত্মসুখের প্রতি বিন্দুমাত্র দৃষ্টি না করে কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধান করার নাম যে প্রেম তা কেমলমাত্র ব্রজগোপীগণই উপলদ্ধি করতে সমর্থ হন। প্রেমজগতে উচ্চ যে অবস্থা যার নাম অধিরূঢ় মহাভাব তা একমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । কেন-
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে-
অতএব কাম প্রেম বহুত অন্তর ।
কাম অন্ধতম প্রেম নির্মল ভাস্কর।।
অতএব গোপীগণে নাহি কাম গন্ধ।
কৃষ্ণসুখ লাগি মাত্র কৃষ্ণ সে সমন্ধ।।
সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিশ্চিত না হলে এবং সম্পূর্ণ অসাধারণ স্বরূপগত অভিমান ত্যাগ করতে না পারলে কখনো প্রেমবান হওয়া যায় না। তাই স্বার্থপর মানুষ মাত্রেই কখনো প্রেমিক হতে পারে না। কারণ সর্বদায় সে কাল, কর্ম্ম, মায়া ও ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে নিশ্চিতভাবে কারও প্রতিই প্রেমবান হতে পারে না।
গুণাবতার পুরুষাবতার হতে আরম্ভ করে পরব্যোধিপতি শ্রীনারায়ন পর্যন্ত যত শ্রীভগবদ পার্ষদ আছেন সকলেই পরম স্বতন্ত্র হলেও নিজেরা সাধু পরিত্রান, ধর্মসংস্থাপনাদি সৃষ্টি কার্যে ব্যস্ত বলে সকলেই ভগবদভিমানী। অতএব তাড়াও ক্ষণকালের জন্য নিশ্চিত হতে বা নিজ ঐশ্বর্য ত্যাগ করতে পারেন না বলে কারও সহিত সরলভাবে প্রেম করতে পারেন না। এমনকি শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশান্তর শ্রীমথুরানাথ ও শ্রীদ্বারকানাথ পর্যন্ত এজন্য এই যথার্থ প্রীতি সাধন করতে পারেন না। একমাত্র ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত কারণ তিনি রাজা নন রাজপুত্র রূপে ব্রজে বিচরণ করেন বলে কাউকে প্রীতি করার কালে নিজের ভগবত্তা পর্যন্ত ভূলে যান। এজন্য তিনিই একমাত্র প্রেমিক হওয়ার যোগ্য।
তাই সম্পূর্ণরূপে অন্যাভিলাষ (কৃষ্ণ সুখ ভিন্ন অন্য যে কোন বাসনা) এমনকি স্বসুখ অনুসন্ধানের লেশমাত্র হৃদয়ে থাকলে কখনো যথার্থ প্রেমিক হওয়া যায় না।
ফলে ব্রজগোপীগণ ব্যতীত এই প্রকার ভাব আর কোথাও দৃষ্ট হতে দেখা না। কারণ একমাত্র তাঁরাই লোকধর্ম্ম, বেদধর্ল্ম, দেহধর্ম, লজ্জা, ধৈর্য্য, দেহসুখ, আত্মসুখ, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধবসহ আশেপাশের সকল এবং তাদের দ্বারা পীড়ন, তাড়না, ভৎর্সনা প্রভৃতি সকল কিছু পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র কৃষ্ণ সুখের নিমিত্তে প্রেমসেবা করেন। সেজন্যই ব্রজগোপীগণই কৃষ্ণকে যথার্থ প্রীতি সাধন করাতে পারেন।
ব্রজগোপীগণের নিজেদের কোন প্রকার সুখবাঞ্চা না করে শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণ সুখ বিধান করার জন্যই তাদের অঙ্গে সকল সময় এক সুখ তরঙ্গ প্রকাশ পায় । এমনকি তাঁরা নিজেরা যে অঙ্গমার্জনাদি করে বষণভূষাণা হয়ে সুশোভিত হন তাও কৃষ্ণ তাঁদের দেখে যেন সুখ পান কৃষ্ণের সন্তোষ বিধানের জন্যই তা করেন।
নিজাঙ্গমপি যো গোপ্যা মমেতি সমুপাসতে।
তাভ্যঃ পরং ন মে পার্থ নিগুঢ়প্রেমভাজনম্।।
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হচ্ছে-
আমার দর্শনে কৃষ্ণ পাইল এত সুখ।
এই সুখে গোপীর প্রফুল্ল অঙ্গ মুখ।।
আবার গোপীগণের শোভা দর্শন করে শ্রীকৃষ্ণের যে সুখ হয় তা দেখে গোপীগণ আরো বেশি প্রফুল্লিত হলে কৃষ্ণ অনুভব করে এবং দেখে যে কৃষ্ণ নিজে যে সুখ আস্বাদন করছেন সেই সুখের চেয়ে গোপীদের সুখ বহুগুণ বেশি।
গোপীশোভা দেখি কৃষ্ণের শোভা বাড়ে যত।
কৃষ্ণশোভা দেখি গোপীর শোভা বাড়ে তত।।
অতএব সেই সুখে কৃষ্ণসুখ পোষে।
এই হেতু গোপীপ্রেমে নাহি কাম দোষে।।
প্রেমময়ী গোপীদের এইসুখ আস্বাদন করার জন্যেই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ হয়েও তিনি ব্রজগোপী শ্রেষ্ঠ শ্রীমতিরাধীর ভাবে ভাবিত হয়ে কলিযুগে ভক্তরূপে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য হন।
সুপ্রিয় গৌরভক্তবৃন্দ ভক্তানন্দ উপভোগ করার জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র গৌরচন্দ্র রূপ ধারণ করেছেন সেই ভক্তদের গুরুবাদ বুদ্ধিতে যারা অপমান নিগৃহিত করে কৃষ্ণভক্তিপ্রচারমূলক কার্যে বাধা সৃষ্টি প্রচেষ্টা করেন তারা কি শ্রীল প্রভুপাদের প্রকৃত আদর্শ অনুসরণ করেন ? গীতা পাঠ করে ও করিয়ে কি তারা এই শিক্ষাই অনুসরনকারীদের প্রদান করছেন ? শ্রীল প্রভুপাদ কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য লীলা অবতারের চেয়ে বলরাম ও কৃষ্ণলীলাকেই কি বেশি প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেননি ?
কৃষ্ণ
লীলার অনুকরণে তথাকথিত যে সমস্ত কামুক
স্বভাবি তথাকথিত প্রচারকরা সবকিছুকে নিজের ভোগ্য বৃদ্ধিতে বিবেচনা করেন তাদের কাছে কৃষ্ণকথা প্রসাদ বেশি বেশি বিতরণ করা উচিত যেন সেই
প্রসাদ গ্রহণের ফলে কামুকবৃত্তি পশমিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের কিছুটা হলেও গুরুবাদ বুদ্ধি থেকে নিবৃত্তি হতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই