এইসব অনর্থগুলি ষড়রিপুর জন্ম দেয়
(১) কাম - কাম শব্দে বাসনা বা ইচ্ছা। ইহা রজোগুণ সমুদ্ভূত। কামের ন্যায় দুরাসদ বৈরী মানুষের আর নেই। ইহার দ্বারা চালিত হলে এমন কোন অন্যায় কর্ম নেই যা মানুষ না করতে পারে। সম্বন্ধ জ্ঞানের অভাবেই সর্বপ্রকার বাসনার উদ্ভব হয়। কাম দ্বারা আহতচিত্ত হয়ে জীবের সংসার গতি উপস্থিত হয় এবং অবিদ্যার দ্বারা আবৃত হয়ে জীব বহু ভোগের বিষয় কল্পনা করে। ভোগের বিষয়গুলি সত্য নাহলেও বর্তমানে সম্বন্ধ জ্ঞানের অভাবে সত্য বলে প্রতীত হচ্ছে। নীতি শাস্ত্রে যে কাম পরিত্যাগের ব্যবস্থা আছে, তা ন্যূনাধিক পরিমাণে অন্যান্য বাসনার দ্বারা আবৃত। সর্ব প্রকার কাম, কামদেব শ্রীকৃষ্ণে নিয়োজিত না হওয়া পর্যন্ত কাম দূর হয় না।
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (আদি ৪/১৬৫-১৬৬,১৭১) কামের স্বরূপ ও তা পরিত্যাগের যে বৈজ্ঞানিক উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে তা হতে জানা যায় - কাম অন্ধতম একটি অবস্থা, আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিই তার প্রবর্তক। কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিরূপ প্রেম ভাস্করের উদয়েই তার অপগম হয়।
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্চা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ॥১৬৫॥
কামের তাৎপর্য - নিজ সম্ভোগ কেবল।
কৃষ্ণসুখ তাৎপর্য - মাত্র প্রেম ত’ প্রবল॥১৬৬॥
অতএব কাম-প্রেম বহুত অন্তর।
কাম অন্ধতমঃ প্রেম-নির্মল ভাস্কর॥১৭১॥
একমাত্র গোপীগণের বাঞ্ছাই কামগন্ধহীন, কারণ তাঁদের সর্বপ্রকার কৃত্য কৃষ্ণ সুখের জন্য। তাঁরাই যথার্থ নিষ্কাম। প্রবৃত্তি মার্গে স্ত্রী গ্রহণাদি দ্বারা নৈসর্গিক প্রকৃতিকে ক্রমান্বয়ে বিধির বশীভূত করে নিবৃত্তি মার্গে প্রবেশ করবার চেষ্টা থাকেলেও তা হতে সুফল প্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্বন্ধে শাস্ত্রে বলা হয়েছে -
“ ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।” অর্থাৎ কাম উপভোগের দ্বারা কখনই ‘কাম’ দুরীভূত হয় না বরং আগুনে ঘৃতাহুতির ন্যায় কাম বাসনার বৃদ্ধি হয়। কিন্তু কিছুকাল কামের উপাসনা করলে বুঝা যায়, কাম প্রতিপালন করতে পারে না। তখন তা হতে অতিক্রান্ত হতে গিয়ে মুক্তির জন্য যে চেষ্টা করা হয়, তাও কামের প্রকার ভেদ। যারা নিজ চেষ্টার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভগবানের শরণাপন্ন হন, তাঁদের সম্বন্ধে শাস্ত্রে বলা হয়েছে -
কামাদীনাং কতি ন কতিধা পালিতা দুর্নিদেশা-
স্তেষাং জাতা ময়ি ন করুণা ন ত্রপা নোপশান্তিঃ।
উৎসৃজ্যৈতানথ যদুপতে সাম্প্রতং লব্ধ বুদ্ধি-
স্তামায়াতঃ শরণমভয়ং মাং নিযুক্সক্ষাত্ম দাস্যে॥
ভক্তিরসামৃতসিন্ধু(৩/২/৩৫)
হে ভগবান ! আমার কামনা বাসনার অবাঞ্ছিত আদেশের কোন শেষ নেই। যদিও আমি তাদের অনেক সেবা করেছি, কিন্তু তারা আমাকে কোনই করুণা প্রদর্শন করেনি। তাদের সেবা করে আমি কখনও লজ্জিত হইনি। তাদের ত্যাগ করার বাসনাও আমি কখনও করিনি। হে প্রভু ! হে যদুপতি ! সম্প্রতি আমার বুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে এবং আমি তাদের ত্যাগ করেছি। চিন্ময় বুদ্ধির ফলে আমি এখন এই সব বাসনার অবাঞ্ছিত আদেশ অমান্য করছি। এখন আমি আপনার অভয় চরণের শরণ নিতে এসেছি। অনুগ্রহ করে আপনার সেবায় আমাকে নিযুক্ত করুন। আমাকে উদ্ধার করুন।
কিন্তু এরূপ শরণাগত হতে গিয়েও যদি নানা প্রকার গুপ্ত কামের সেবা করে বসি, তাহলে আর সুফল লাভ হল না। কামকে কৃষ্ণ সেবায় অর্পণ অর্থাৎ স্বীয় ইচ্ছাকে কৃষ্ণের ইচ্ছানুগত না করে যদি স্ব-স্বভাবে বিভোর হয়ে গুরুর আনুগত্য ছেড়ে ইন্দ্রিয় তোষণের চেষ্টায় মগ্ন থাকি, তাহলে কামকে দমন করা সম্ভব হল না। জীব বহু চেষ্টা করেও কামনার হাত হতে নি®কৃতি পায় না। বদ্ধজীবকে বিপ্রলিপ্সা দোষে মায়াদেবী কর্তৃক পুনঃ পুনঃ বঞ্চিত হতে হয়। ভগবান ও সাধু গুরুর চরণে নিষ্কপট শরণাগতি না হওয়া পর্যন্ত কামনার হাত হতে পরিত্রাণ লাভের উপায় নেই।
(২) ক্রোধ- কাম বাধা প্রাপ্ত হলে যে সমস্ত দৈহিক তাড়নাদি ও মানসিক আক্রোশাদি আসে তা ক্রোধ নামে কথিত হয়। ইহা রজোগুণ সমুদ্ভূত, কামনা হতে জাত। এজন্য কর্মী লোকেরই ইহার প্রাকাট্য দেখা য়ায়। ক্রোধ দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষ পরমার্থ বিচ্যুত হয় - পরমার্থ কেন, ধর্ম, অর্থ, কামাদি লাভেও বঞ্চিত হয়। এজন্য নীতি শাস্ত্রে কামের ন্যায় ক্রোধও নিন্দিত হয়েছে। ক্রোধের রূপ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এমনকি লোকে ক্রোধের বশীভূত হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে।
শ্রীল রূপগোস্বামী উপদেশামৃতের প্রথম শ্লোকে হরিভজন প্রয়াসীকে বলেছেন -
বাচো বেগং মনসঃ ক্রোধ বেগং
জিহ্বাবেগমুদরো উপস্থ বেগং।
এতান বেগান যো বিষহেত ধীরঃ
সর্বামপীমাং পৃথিবীং স শিষ্যাৎ॥
এতান বেগান্ অর্থাৎ বাক্য, মন, ক্রোধ, জিহ্বা, উদর ও উপস্থের বেগ যে ধীর ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনি পৃথিবীকে শাসন করতে সমর্থ। ধীর অর্থাৎ শান্ত।
কৃষ্ণভক্ত নিষ্কাম অতএব শান্ত।
ভূক্তিমুক্তিসিদ্ধিকামী সকলি অশান্ত ॥
বাস্তবিকই একমাত্র কৃষ্ণভক্তই শান্ত, তাছাড়া অন্যান্য সকলে স্ব স্ব কাম কর্তৃক চালিত হয়ে ও কামের বাধা প্রাপ্তিতে ক্রোধান্ধ হয়ে অশান্ত।
ভোগী ও ত্যাগী উভয় সম্প্রদায়ের কাম বাধা প্রাপ্ত হলে ক্রোধে উদ্দীপ্ত হয়। ভক্তের ক্ষেত্রে এরকম ক্রোধের সম্ভাবনা নেই, কারণ তিনি সর্বপ্রকার হৃদগত কাম কৃষ্ণসেবায় নিয়োজিত করে নিত্যকালের জন্য কর্ম বন্ধন থেকে নির্মুক্ত হয়ে স্বীয় স্বরূপে সিদ্ধ বৃত্তিতে অধিষ্ঠিত আছেন। খুব দৃঢ় বিশ্বাসরূপ ভিত্তির উপর এই বৃত্তি প্রতিষ্ঠিত। মৎসরতা বশে ভোগী ও ত্যাগী উভয় সম্প্রদায় ভক্তের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। তাই ভক্ত, (ভক্ত দ্বেষীকে) আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষকে শ্রীচৈতন্য মহাপর্ভুর প্রেমধর্মের দ্বারা তাদের স্বীয় স্বরূপ উপলব্ধি করাবার চেষ্টা করেন। শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর মহাশয় গেয়েছেন - ‘ ক্রোধ ভক্তদ্বেষীজনে,’ তাই ভক্ত বিদ্বেষীর প্রতি ক্রোধ। ভক্ত আপাত মধুর ভোগকে অনুমোদন না করলেও জীবের পরম বন্ধু। দুর্ভাগা ব্যক্তি বৈষ্ণবের উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে নিজেন্দ্রিয় তর্পণের ব্যাঘাতে তাদের প্রতি আক্রোশ পোষণ করে জন্ম জন্মান্তরের জন্য ভক্তি মন্দির থেকে বিদায় লাভ করেন। কেহ বা ভক্ত ও ভগবানকে মারবার চেষ্টা করে। কিন্তু বৈষ্ণব এরূপ কোন সদোষ পরিমিত কুন্ঠাময় স্থানে বাস করেন না যে তারা ও তাদের ব্যাবহৃত দ্রব্যসকল তথায় গতি লাভ করতে পারে।
বৈষ্ণব নিত্যকালই বৈকুন্ঠ বাসী - তথায় কোন প্রকার শোক ও ভয় নেই, অমৃতই তথাকার আস্বাদনীয় বস্তু। আর যিনি সেই অমৃত আস্বাদন করেছেন, তিনি অজড় ও অমর। জীবগণকে কামরূপ তীর বিদ্ধ হয়ে ছটফট করতে দেখে উহা হতে উদ্ধার করার জন্য আপাত ক্ষণিক কষ্ট দিতে যিনি শঙ্কিত হন না ,নানা প্রকার বিরুদ্ধ মতবাদীর প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তাদের ক্রোধোৎপত্তি হবে জেনেও ভগবৎ বাণী প্রচারে কুন্ঠিত হন না। তাঁর ভগবানে আত্মনিবেদন ও জীবে দয়া আদর্শ স্থানীয়। তিনিই সদ্গুরু। বদ্ধ জীবের জড় ভোগ কামনার ব্যাঘাত হলে যে ক্রোধের উদয় হয়, তা আদরনীয় নহে। কিন্তু গুরু বৈষ্ণব বিদ্বেষীর দন্ডবিধানার্থ যে ক্রোধ, তা ভক্ত্যঙ্গ। যিনি সত্য ধ্বংস করতে উদ্যতজনে অবাধে মৌনভাবে অনুমতি প্রদান করেন, তার ভক্তিপথ রুদ্ধ জানতে হবে।
(৩) লোভ- লোভের অপর নাম দ্বিতীয়াভিনিবেশ। মায়িক বৈচিত্রে মোহিত হয়ে জীব কামনা পরবশ হয়। কামের বাধা প্রাপ্তিতে যেরূপ ক্রোধ উদ্গত হয়, তেমনি কিঞ্চিৎ মাত্র কামের সফলতায় জীব লোভাভিভূত হয়। ইন্দ্রিয়গণ স্বাভাবিক অনুরাগভরে অসংখ্য বাধা বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে যে বৃত্তিবশে বিষয়ের প্রতি ধাবিত হয় তা লোভ নামে কথিত হয়। ইহা মনেরই একটি অনুরাগময়ী চেষ্টাবিশেষ। ক্রোধের ন্যায় লোভও পরমার্থ সাধনে দ্বিতীয় কন্টক স্বরূপ। ব্যাধের বংশী ধ্বনীতে আকৃষ্ট হরিণের ন্যায় জীবগণ ইন্দ্রিয়গণের প্ররোচনায় মুগ্ধ হয়ে মায়াজালে নিবদ্ধ হয়। তখন জড় মায়াকে ভোগ বা অতিক্রম করতে গিয়ে অনন্ত অপার বাসনারাজি দ্বারা ক্রম প্রবাহমান চক্রে ঘূর্ণায়মান হয়েও মায়ার সীমা অতিক্রম করতে না পেরে নিতান্ত পরাধীন বা বদ্ধাবস্থায় বাস করে।
লোভ জীবগণকে কেবল জালবদ্ধ করে ছেড়ে দেয় না। বদ্ধ অবস্থায় মানবগণ লোভ দ্বারা চৌর্যবৃত্তিপর দার অপহরণাদি অবৈধ ব্যাপারে লিপ্ত হয়ে নানাবিধ দুষ্কর্মের আবাহন করে থাকে। শাস্ত্রীয় সম্বন্ধ জ্ঞানের অভাবে পরকালে সুখ প্রাপ্তির আশায় কর্মে নিয়োজিত থেকেও লোভের হাত হতে একেবারে নি®কৃতি পান না। আর অন্য সম্প্রদায় সংসারের সকল আশাভরসা জলাঞ্জলি দিয়ে লোভের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিব্রাজক বেশে বনে গমন করেও ভগবানের চরণে শরণাগতির অভাবে পুনঃ লোভের হাতে পতিত হয়ে রাবণের সীতা হরণের ন্যায় লোভে লিপ্ত হয়ে নিধন প্রাপ্ত হয়।
ভক্তগণ লোভকে সাধুসঙ্গে হরিকথায় নিয়োজিত করে মায়িক লোভের হাত হতে পরিত্রাণ পান। তাঁরা জানেন, ব্যতিরেকভাবে বিষয় পরিত্যাগের চেষ্টা ফলবতী হয় না ; কারণ প্রত্যেক স্বার্থের গতিই বিষ্ণু।
ন তে বিদুঃ স্বার্থগতিং হি বিষ্ণুং।
দুরাশয়া যে বহিরর্থমানিনঃ ॥
শ্রীমদ্ভাগবত (৭/৫/৩৯)
বিষ্ণু সম্মুখ বা বিষ্ণু সেবাভিলাষী বস্তুর বিনাশ নেই। কিন্তু দুরাশয়া ব্যক্তি দূরদর্শন রহিত হয়ে স্বার্থকে নিজের ভোগে নিযুক্ত করে। বর্তমান সময়ে সাধুসঙ্গে হরিকথা আলোচনার বড়ই অভাব হয়েছ্।ে কতকগুলি কনক কামিনী প্রতিষ্ঠা লোভী মানুষ স্ব স্ব স্ত্রীপুত্র প্রতিপালনের জন্য ভক্তির দোহাই দিয়ে ভোগে নিজেদের ইন্দ্রিয় তর্পণে ব্যস্ত হয়েছে। যদি সত্য সত্যই তাঁরা সাধূসঙ্গ ও শ্রবণ কীর্তনাদি ভক্তির আদর করতেন তাহলে শ্রীগুরু কৃপাবলে সম্বন্ধ জ্ঞান লাভ করে কৃষ্ণাকর্ষণ তাঁদের স্বাভাবিক হত। তা না করে স্বয়ং কৃষ্ণ কলেবর শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীমূর্তি এবং হরিনামকে তাঁরা অর্থ উপার্জনের মন্ত্র বা পূজ্য বস্তুকে সেবক সূত্রে গ্রহণ করে অররাধের ফলে অধিক লোভের বশবর্তী হয়ে নরকের পথের যাত্রী হচ্ছেন।
(৪) মোহ - মোহ ভগবানের মায়াশক্তি বিশেষ। ষড়রিপুর অন্যতম বা অন্য রিপুপঞ্চকের জননী। সংজ্ঞাবিলুপ্ত বা বস্তুর যথার্থ স্বরূপ ছাড়া বিনিময় জ্ঞানকেও মোহ বলে। কখনও কখনও আমরা শারীরিক দুর্বলতা হেতু ইন্দ্রিয়জ্ঞান হতেও মোহ প্রাপ্ত হয়ে থাকি। তদ্রƒপ চিজ্জগতের অতি ক্ষুদ্র চিৎকণ জীব কৃষ্ণ সেবারূপ বলহীন হলে মায়াকর্তৃক সম্মোহিত হয়ে আত্মবিস্মৃতি লাভ করেন। তখন তাঁর নিত্য সংজ্ঞা বা সম্বন্ধ জ্ঞান আচ্ছাদিত হয়, একেই মোহ বলে। মোহ প্রাপ্ত হলে - জিজ্ঞাসার অভাব, ইন্দ্রিয় অর্থাৎ অবভাসিক জ্ঞানের প্রবলতা, কর্তব্য বিচ্যুত, অনিত্য বস্তু হতে সুখেচ্ছা, ইন্দ্রিয়গণের অনিয়ামকতা ইত্যাদি দোষ জীবকে অতিক্রম করে। তাই ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে -
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে॥
ক্রোধাৎ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্র।
স্মৃতিভ্রংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি॥
ইন্দ্রিয়ের বিষয় সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কাম থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃতি বিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বৃদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।
ভগবদ্গীতা (২/৬২-৬৩)
মায়ার মোহন ক্রিয়া জীবকে মুগ্ধ করে রাখার চেষ্টা করলেও মানবগণ সর্বদা তা মোচনের চেষ্টা করেন। কিন্তু মায়ার বন্ধন কিভাবে মোচন হবে তা না জানার ফলে সেই মায়িক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে। জীব বদ্ধ হলেও তার স্বরূপ ও বৃত্তি একেবারে ভুলে না যাওয়ার ফলে তার দৈহিক ও মানসিক অভাব পরিত্রাণের জন্য অত্যন্ত দক্ষতার সহিত গৃহ নির্মাণ, উত্তম ভোজ্য প্রস্তুত করণ, সামাজিক বিধি বিধান দ্বারা সমাজ রক্ষা, ব্যাধি প্রশমনের জন্য ঔষধ ও নানাবিধ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বারা অভাব দুরীকরণ অন্য প্রাণী অপেক্ষা মানবের বিশেষত্ব। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে প্রহ্লাদ মহারাজ বলেছেন - “ মানুষ্যমর্থদম্” কারণ মনুষ্য জন্মই একমাত্র “অর্থদ”। তাই মানুষ সম্বন্ধ জ্ঞান লাভ করে পরমার্থ অন্বেষনের দ্বারা নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয় নতুবা মায়ার দ্বারা পরিচালিত হয়ে জড়জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্তি ও অনাত্মীয়কে আত্মীয় জ্ঞানে মায়ামরীচিকার পিছনে ধাবমান হয়ে ‘মোহান্ধতা’ প্রাপ্ত হয়। একমাত্র সাধুগুরু কৃপায় জীবের এই মোহান্ধতা নষ্ট হয়।
কর্মী ও জ্ঞানী মোহ পরিত্যাগের নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করেও মোহ হতে উদ্ধার হতে পারেন নাই। ভক্ত যে প্রকারে মোহকে পরিত্যাগ করেছেন তা শ্রীল ঠাকুর মহাশয়ের পদ হতে জানা যায়। “মোহ ইষ্টলাভ বিনে, মদ্ কৃষ্ণগুণগানে, নিযুক্ত করি যথাতথা।” রিপু সকলকে যথাযোগ্য স্থানে নিযুক্ত ছাড়া একেবারে ধ্বংস করার বাসনা ভক্তের নেই, কারণ ভক্ত নির্মৎসর; সর্বভূতে দয়া বিশিষ্ট, কারণ তাঁদের হিংসা নেই।
(৫) মদ - ‘মদ’ অর্থে প্রমত্ততা বা আসক্তি যা ষড়রিপুর অন্যতম। ইহা তমোগুণ সম্ভূত। জীব বিবর্ত বুদ্ধিতে প্রাকৃত বস্তুতে আমিত্ব বুদ্ধি করে তাতে প্রমত্ত হলে উহা ’মদ’ নামে অভিহিত হয়। বিষয় আসক্তি বৃদ্ধির দ্রব্য বিশেষকেও ‘মদ’ কহে। অবৈষ্ণবাভিমানিগণ ইহা দ্বারা মায়ার উপাসনা করে গাঢ়ভাবে বিষয়ে প্রমত্ত হন। অদ্বয়জ্ঞানে ত্রিগুণ সাম্যাবস্থা লাভ করেছে বলে ‘বস্তু’ ও ‘অবস্তু’ ভেদে প্রযুক্ত মদ “জ্ঞানান্মূক্তিঃ জ্ঞানবন্ধশ্চ” এই তত্ত্ব সূত্র নামে বন্ধন ও মুক্তির কারণ হয়ে থাকে। বস্তু অর্থাৎ ভগবান নিত্য অস্তিত্বময় এবং অবস্তু অর্থাৎ কালান্তর্গত প্রতীতি সর্বদা পরিবর্তনশীল মানবগণ ধন, জন, রূপ, বল (শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক) যৌবন ইত্যাদি মায়িক বৈভব জাত পদার্থে অহং ও মমত্ব বুদ্ধি করে সত্য বস্তু হতে দূরে অবস্থান করেন। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৮/২৬) কুন্তীদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রার্থনায় বলেছেন-
জন্মৈশ্বর্যশ্রুতশ্রীভিরেধমানমদঃ পুমান।
নৈবার্হত্যাভিধাতুং বৈ ত্বামকিঞ্চনগোচরম্ ॥
হে পরমেশ্বর ! যারা জড় আসক্তিশূন্য হয়েছে তুমি সহজেই তাদের গোচরীভূত হও। আর যে ব্যক্তি জড়জাগতিক প্রগতিপন্থী এবং সম্ভান্ত কুলোদ্ভূত হয়ে বিপুল ঐশ্বর্য, উচ্চ শিক্ষা, দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে আপন উন্নতি লাভে সচেষ্ট, সে ঐকান্তিক ভাব সহকারে তোমার কছে আসতে পারে না।
অবৈষ্ণবাভিমানী জগতে ন্যূনাধিক সকলেই ‘মদ’ দ্বারা অভিভূত হয়ে সংসারে ভ্রাম্যমান। মায়ার প্রভাবে, ভগবানে আনুগত্যের অভাবে পুনঃপুনঃ দন্ড পেয়েও জীব তা ভুলে গিয়ে পুনরায় সংসার গর্তে পতিত হচ্ছে। আসক্তিই সর্ব দুঃখের কারণ বলে জানতে হবে।
ভগবান নির্মল সেবা বুদ্ধি প্রণোদিত জীব হৃদয়ে যে তত্ত্ব স্ফূরিত করান ইহা ঐরূপ আত্মবিনাশের পরামর্শ নহে। বৃত্তি ও বিষয়ের ভিতর যে ব্যবধান তাই নিরোধ করবার উপদেশ করেন। আসক্তিকে ছেদন করতে হবে না, আসক্তির বিষয় কে, তাই অনুসন্ধান করতে হবে। বিষয় অভাবে বৃত্তি প্রতিহত হয়ে ফিরে আসা স্বাভাবিক ধর্ম। ভগবানের নাম, রূপ, গুণ, লীলা ভক্তালোকে নিয়তই ভক্তের নিকট প্রত্যক্ষ হচ্ছে। ইহা জ্ঞানীর বৃথা অনুমানের অপেক্ষা করে না। সাধন প্রভাবেই সম্বন্ধ জ্ঞান আবির্ভূত হয়, তা অভিধেয় লক্ষণাত্মক ভক্তি। সেই ভক্তিই জীবের পরম প্রয়োজনীয় বস্তু। জ্ঞানীগণ ‘মদ’ পরিত্যাগ করতে গিয়ে জ্ঞান মদে প্রমত্ত , তাই তারা সত্য বস্তু ধারনা করতে অসমর্থ। শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর গেয়েছেন -
“মদ কৃষ্ণ গুণগানে, নিযুক্ত করিব যথাতথা।
আনন্দ করি হৃদয়, রিপু করি পরাজয়,
অনায়াসে গোবিন্দ ভজিব।
জীবমায়া ত্রিগুণের দ্বারা বিক্ষুব্ধ হয়ে কৃষ্ণের অপ্রাকৃত গুণগান হতে বিরত হয়, তাই আসক্তি তার বন্ধনের কারণ হয়েছে। একমাত্র কৃষ্ণ কীর্তনের দ্বারাই তা নিরস্ত হয়। যোগ-জ্ঞান পন্থা অবলম্বনে আনন্দের ধ্বংস দ্বারা রিপু সকলকে পরাভূত করার যে পন্থা, তা ক্লেশজনক। ভক্ত তাদৃশ ক্লেশজনক পন্থার পথিক নহেন’ তাঁরা আনন্দের সমৃদ্ধির দ্বারা রিপু সকলকে নিযুক্ত বা পরাজয় করে অনায়াসে শ্রীগোবিন্দের ভজনা করেন। ইহাই আত্মার সাহজিক ধর্ম।
(৬) মাৎসর্য- ছয়রিপুর মধ্যে মাৎসর্য বা মৎসরতাই সর্ব প্রধান। মাৎসর্য শব্দের অর্থ - পরশুভ দ্বেষ, পরশ্রী কাতরতা, অসূয়া ও ঈর্ষা ইত্যাদি। বৈষ্ণব শাস্ত্রে যে যে স্থানে মাৎসর্য শব্দের ব্যাবহার হয়েছে তাদ্বারা প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবকে বুঝিতে হয়।
জীবের সমস্ত ক্লেশই মাৎসর্যের অন্তর্গত। অবিদ্যা, পাপ বাসনা ও পাপ, তথা অবিদ্যা , পূণ্য বাসনা ও পূণ্য - এ সমস্তই মাৎসর্যের অন্তর্গত।
কারও মতে অন্য রিপুগুলি মাৎসর্যের সহচর এবং কেহ কেহ বলেন যে, অপর রিপুগুলি মাৎসর্যের অন্তর্ভূক্ত অর্থাৎ কায়ব্যূহ মাত্র। ভগবানই একমাত্র বাস্তব বস্তু এবং নির্মৎসরগণই তাঁকে অবগত হয়ে থাকেন। “ধর্ম প্রোজ্ঝিতকৈতর্বহত্র পরম নির্মৎসরনাং সতাম্” - এই ভাগবত বাক্যের দ্বারা পরম ধর্মের অধিকারী নিরুপিত হয়েছে। প্রেম রসই ঐ শাস্ত্রের নির্দিষ্ট পরম ধর্ম। যিনি নির্মৎসর তিনিই ঐ ধর্মের অধিকারী। নির্মৎসর গণ কর্তৃকই অনর্থের নাশ সম্ভব। অনর্থ নষ্ট না হলে ভগবৎ অনুভূতির যোগ্যতা হয় না। মৎসরতার অপগমে অন্য রিপু বর্গের নাশ হয় বলে অন্য রিপুগুলি মাৎসর্যের সহচর। রিপু অর্থে শত্রু। শত্রুর ধর্ম অনিষ্ট সাধন করা। মাৎসর্যকে ভীষণ কালকূট সদৃশ বিবেচনা করাই সমীচীন। হিংসা বা পরশ্রী কাতরতা বা পরসুখ অসহনশীলতা নামক যে বীভৎস বৃত্তি অজ্ঞানাচ্ছন্ন মানব হৃদয়ে তান্ডব নৃত্য করে, তা মৎসরতারই প্রকার ভেদমাত্র। বহির্মুখ বদ্ধজীবে আত্ম ইন্দ্রিয় তর্পনে নিযুক্ত রিপুপঞ্চক প্রবল হয়ে একত্রিত হলে মাৎসর্য রূপে পরিণত হয়। জীবে দয়া নামে রুচি, বৈষ্ণব সেবারূপ বৈষ্ণব ধর্ম একদিকে এবং অপরদিকে মাৎসর্য অবস্থান করে। যিনি পরসুখে দুঃখী তিনি কখনও জীবে দয়া করেন না। ভগবানের প্রতি তার সরস ভাব উদয় হয় না। বৈষ্ণবের প্রতি তার নিসর্গ ঘৃনা থাকে।
যাঁরা ভোগ-মোক্ষ নিরাকাক্সক্ষী তাঁরা স্বার্থপরতার পরিবর্তে ভগবানের সুখান্বেষী হয়ে থাকেন। ভগবৎ সুখ তাৎপর্য বিহীন স্বার্থপর মানব স্বসুখ বিধানার্থে হিংসাকে আশ্রয় করে। হিংসাবৃত্তি প্রকট হলে তৎসহচর অন্য রিপুপঞ্চক একে একে মাৎসর্যপূর্ণ হৃদয়ে আবির্ভূত হয় ও তাদের তান্ডব নৃত্য কালে সেই মূঢ় মানব ক্রমশঃ প্রতিদ্বন্দ্বীতার ক্ষেত্রে বিচরণ করতে করতে নরকাভিমুখে গমন করতে থাকে। ভোগ বা মোক্ষকামী মানবগণ হিংসাক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত হয়ে যে ভীষণ হিংসাজাল বিস্তার করছে, অজ্ঞানান্ধতা বশতঃ স্বীয় বলে তা ছিন্ন করতে সম্পূর্ণ অসমর্থ । যাঁরা সুকৃতি সম্পন্ন সদ্গুরুর চরণে শরণাগত হয়েছেন, জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হওয়ায় কেবলমাত্র তাঁরাই হিংসার ভীষণ আকার সন্দর্শন করতে ও তন্নির্মিত জাল ছেদন করতে সমর্থ হন।
জাগতিক ভালবাসার মূলদেশে মাৎসর্যের সহচররূপ স্বার্থপরতা প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করে; তার প্রেরণায় নিজ ছিদ্রটিকে কেহ সহসা অন্যের নিকট স্বার্থ হানির ভয়ে ব্যক্ত করতে চায় না। মৎসরগণ ইহা বুঝেও বোঝে না। সাধুবেশধারী রাবনের ন্যায় হিংসাবৃত্তি স্বীয় বীভৎস্বরূপ আচ্ছাদন করে মোহন মূর্তিতে বদ্ধজীবকে মুগ্ধ করে সর্বনাশ করে। মৎসরগণ কর্তৃকই যাবতীয় গর্হিত কার্য সম্পন্ন হতে দেখা যায়। পরদ্রব্য হরণ, পরস্ত্রী হরণ, মিথ্যা ভাষণ, জীবহত্যা, সাধূ নিন্দা, ভগবৎ বিদ্বেষ, অসৎ শাস্ত্র প্রনয়ণ, কপট ভক্তি প্রচার ইত্যাদি জঘন্য কার্য করতে মৎসরগণ আদৌ পশ্চাৎপদ নহে, বরং এই সব কার্য সাধনের জন্য তারা সতত লালায়িত থাকে ও তা নির্বিঘেœ সম্পন্ন হলে আপনাদিগকে কৃতার্থ মনে করে। যদি মাৎসর্যের দ্বারা কেউ আক্রান্ত না হতেন, তাহলে কুশিক্ষা জগতে স্থান পেত না এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ সুখের আলয়রূপে দৃষ্ট হত - জগৎ বৈকুন্ঠকারে ভাসমান থাকত।
মাৎসর্যশূন্য ব্যক্তিই তুণাদপি শ্লোকের তাৎপর্য গ্রহণে সমর্থ। যিনি মাৎসর্যশূন্য ব্যক্তি তিনিই তৃণাদপি শ্লোকের তাৎপর্য অঙ্গীকার করেছেন। শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেছেন -
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়া সদাহরি ॥
মাৎসর্যশূন্য ব্যক্তির ধনমদ, রূপমদ প্রভৃতি থাকে না। অতএব তিনি আপনাকে তৃণাপেক্ষা হীন বলে জানেন। মাৎসর্য শূন্য ব্যক্তির ক্রোধ, তীব্রতা ও পরহিংসা থাকে না। অতএব তিনি বৃক্ষ হতে সহিষ্ণু এবং পরম দয়ালু। জাতিবিদ্যা মদাদি রহিত নির্মৎসর পুরুষ সমস্ত গুণ সম্পন্ন ও প্রতিষ্ঠাশূন্য, অতএব তিনি অমানী। নির্মৎসর ব্যক্তি পরসুখে সুখী এবং পরদুঃখে দুঃখী। অতএব সর্বজীবে তিনি যথাযোগ্য মান প্রদান করে থাকেন।
শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর মহাশয় অন্য পাঁচটি রিপুকে ভগবৎ সেবায় নিযুক্ত করতে উপদেশ দিয়েছেন, কিন্তু মাৎসর্যকে ভগবৎ সেবায় নিযুক্ত করতে বা তার শোধনার্থে কোন ব্যাবস্থাই দেন নাই কারণ অন্যান্য কামক্রোধাদি রিপুগণ মাৎসর্য সংযুক্ত হওয়াতেই তাদের রিপুত্ব। মাৎসর্য বিহীন হলে তারা আর রিপু না হয়ে পরম বন্ধু হয় এবং ভক্ত্যঙ্গরূপে পরিণত হয়।
কোন মন্তব্য নেই