তত্ত্ববিভ্রম
আমি শুদ্ধ চিৎকন, কৃষ্ণদাস ইহা ভুলে স্ব-স্বরূপ হতে বদ্ধ জীব দূরে পড়েছে, সেই স্ব-সরূপের অপ্রাপ্তিই তত্ত্ববিভ্রম।
তত্ত্ববিভ্রম চার প্রকার ....
ক) স্ব-তত্ত্ব ভ্রম ঃ - নিজ স্বরূপ সম্বন্ধে অজ্ঞতা বা বিভ্রম। জীবের স্বরূপ হলো শ্রীকৃষ্ণের নিত্য সেবক। শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধানই জীব-স্বরূপের স্বরূপগত ধর্ম। কিন্তু অনাদি কাল হতে কৃষ্ণ বহির্মুখ জীব নিজের স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে “মায়াভোক্তা” আমি মায়াকে ভোগ করব -এই অভিলাষের বশে সংসারে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ইহাই জীবের স্বরূপভ্রম রূপ অনর্থ। এই সম্পর্কে শ্রীল জগদানন্দ পন্ডিত তাঁর প্রেমবিবর্ত নামক গ্রন্থে বলেছেন -
চিৎকণ-জীব,কৃষ্ণ চিন্ময় ভাস্কর।
নিত্যকৃষ্ণ দেখি’ কৃষ্ণ করেন আদর॥
কৃষ্ণ-বহির্মুখ হঞা ভোগ-বাঞ্ছা করে।
নিকটস্থ মায়া তারে জাপটিয়া ধরে॥
পিশাচী পাইলে যেন মতিচ্ছন্ন হয়।
মায়াগ্রস্ত জীবের হয় সে ভাব উদয় ॥
আমি নিত্য কৃষ্ণদাস, এই কথা ভুলে।
মায়ার নফর হঞা চিরদিন বুলে ॥
কভু রাজা, কভু প্রজা, কভু বিপ্র শূদ্র।
কভু দৃঃখী, কভু সুখী, কভু কীট ক্ষুদ্র॥
কভু স্বর্গে, কভু মর্তে, নরকে বা কভু।
কভু দেব, কভু দৈত্য, কভু দাস প্রভু॥
এইরূপে সংসার ভ্রমিতে কোন জন।
সাধুসঙ্গে নিজতত্ত্ব অবগত হ’ন॥
নিজতত্ত্ব জানি’ আর সংসার না চায়।
কেন বা ভজিনু মায়া করে হায় হায়॥
কেঁদে বলে, ওহে কৃষ্ণ ! আমি তব দাস।
তোমার চরণ ছাড়ি’ হৈল সর্বনাশ॥
কৃপা করি’ কৃষ্ণ তারে ছাড়ান সংসার।
কাকুতি করিয়া কৃষ্ণে যদি ডাকেএকবার॥
মায়াকে পিছনে রাখি’ কৃষ্ণপানে চায়।
ভজিতে ভজিতে কৃষ্ণপাদপদ্ম পায়॥
কৃষ্ণ তারে দেন নিজ চিচ্ছক্তির বল।
মায়া আকর্ষণ ছাড়ে হইয়া দুর্বল॥
সাধুসঙ্গে কৃষ্ণনাম - এই মাত্র চাই।
সংসার জিনিতে আর কোন বস্তু নাই॥
খ) পরতত্ত্ব ভ্রম - পরমেশ্বর ভগবানের স্থিতি বা স্বরূপ সম্বন্ধীয় অজ্ঞতা। শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীবের স্মৃতি বিপর্যয় ঘটেছে। ফলে পরম তত্ত্ব বা স্বরূপ শক্তির কৃপা থেকে জীব বঞ্চিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ বিভু চৈতন্য, নিত্য প্রভু, নিত্য সেব্য বস্তু। সৎ-চিৎ-আনন্দময়তা শ্রীকৃষ্ণের নিত্য স্বরূপ। গীতায় অর্জুন বলেছেন -
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্।
পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন যে, আপনি পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, নিত্য পুরুষ দিব্য আদি দেব, অজ এবং সর্বব্যাপক। জীব স্বীয় স্বাতন্ত্রের অপব্যবহারের ফলে পরম তত্ত্ব বস্তু শ্রীকৃষ্ণকে, তাঁর স্বরূপকে ভুলে আছে। ইহাই জীবের পর তত্ত্বে ভ্রম রূপ অনর্থ।
গ) সাধ্য-সাধন তত্ত্বে ভ্রম - প্রেমভক্তির চরম লক্ষ্য বা সাধ্য ও সাধন বা ভক্তির অনুশীলন সম্বন্ধে বিভ্রান্ত। পঞ্চম পুরুষার্থ শ্রীকৃষ্ণ প্রেমই আমাদের সাধ্য এবং মুখ্য কাম্য বস্তু। শ্রীকৃষ্ণের সাথে আমাদের সম্বন্ধ বিস্মৃতির ফলে সম্বন্ধ জ্ঞানের অভাব বশতঃ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষকে সাধ্য বলে মনে করে ঐ চতুবর্গকে লাভের জন্য সাধনায় তৎপর হই। ইহা আমাদের সাধ্য-সাধন ভ্রম রূপ অনর্থ। কেননা ভক্তি শাস্ত্রে ঐ চতুবর্গকে কৈতব বা আত্মবঞ্চনা বলা হয়েছে। ধর্ম-অর্থ-কামাদির দৈহিক সুখের আপাতঃ রমনীয়তায় আমাদের মুগ্ধ করে নিত্য সাধ্য-সাধন বস্তুকে আড়াল করে রেখে অনর্থের বশীভূত করে রেখেছে।
ঘ) বিরোধী বিষয়ে ভ্রম - কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল বিষয়াদি সম্বন্ধে অজ্ঞতা অর্থাৎ ভজনের প্রতিকুল বিষয়কে অনুকুল মনে করা। কৃষ্ণভক্তি অনুশীলনের প্রতিকুল বিষয়াদি ভজনীয় জীবনের প্রতিবন্ধক জড়াত্মক কর্ম-জ্ঞান-অষ্টাঙ্গ যোগাদির অনুশীলন ভক্তির অনুকূুল নয়। ভক্তি যাজনের প্রতিকূল ব্যাপারাদি কখনো ভক্তি অঙ্গে সঙ্গে সংযোগ সাধন করা উচিত নয়। কর্ম কান্ডীয় যজ্ঞ, তপস্যা, বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিপালন কৃষ্ণভজনের ক্ষেত্রে প্রবল অনর্থের সৃষ্টি করে।
জীবের অনর্থগুলি মেঘের ন্যায় নামসূর্যকে ঢেকে অন্ধকার করে; বস্তুত বদ্ধজীবের চক্ষুকেই ঢাকে; নামসূর্য বৃহৎ অতএব তাঁকে ঢাকতে পারে না।
নাম সূর্যসম নাশে মায়া অন্ধকার।
মেঘকুজ্ঝটিকা নামে ঢাকে বার বার ॥
জীবের অজ্ঞান আর অনর্থসকল।
কুজ্ঝটিকা মেঘরূপে হয়ত প্রবল ॥
সম্পদের লোভে মানুষের যে আরও পনেরটি অনর্থের উদ্ভব হয়, সে সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/২৩/১৮-১৯) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে অবন্তী ব্রাহ্মণের কাহিনী প্রসঙ্গে উপদেশ প্রদানকালে বলেছেন -
স্তেয়ং হিংসানৃতং দম্ভঃ কামঃ ক্রোধঃস্ময়ো মদঃ।
ভেদো বৈরমবিশ্বাসঃ সংস্পর্ধা ব্যসনানি চ ॥১৮॥
এতে পঞ্চদশানর্থা হর্য্যমূলা মতা নৃনাম।
তস্মাদনর্থমর্থাখ্যং শ্রেয়োহর্থী দূরতস্ত্যজেৎ॥১৯॥
সম্পদের লোভে মানুষ পনেরটি অনর্থের দ্বারা কলুষিত হয় যেমন- চৌর্য, হিংস্রতা, মিথ্যা ভাষণ, কপটতা, কামবাসনা, ক্রোধ, বিভ্রান্তি, গর্ব, কলহ, শত্রুতা, অবিশ্বাস, হিংসা, ,অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ, জুয়া, নেশা - এই সমস্ত অনর্থগুলির প্রতি মানুষ অনর্থক মূল্য আরোপ করে। সুতরাং যিনি জীবনের প্রকৃত কল্যান কামনা করেন , তাঁর কর্তব্য হচ্ছে অবাঞ্ছনীয় জড় ঐশ্বর্য থেকে দূরে থাকা।
কোন মন্তব্য নেই