একাদশী-তিথিতে অন্নভোজন নিষেধ-কেন ?

 




ব্রহ্মবৈবর্ত্ত-পুরাণে (২৬/২৪-২৬) দেবর্ষি নারদকে শ্রীনারায়ণ বলিয়ংাছেন-

                          সতাং সর্ব্বাণি পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।

                          সন্ত্যেবৌদনমাশ্রিত্য শ্রীকৃষ্ণব্রতবাসরে ॥

                          ভুঙ্ক্তে তানি চ সর্ব্বাণি যো ভুঙ্ক্তে তত্র মন্দধীঃ।

                          ইহাতিপাতকী সোহ্নপি যাত্যন্তে নরকং ধ্রুবম্ ॥

                          একাদশী প্রমাণানি যুগসংখ্যাকৃতানি চ।

                          কুম্ভীপাকে মহাঘোরে স্থিত্বা চ-ালতাং ব্রজেৎ ॥

                          গলিত-ব্যাধিযুক্তশ্চ ততঃ সপ্তসু জন্মসু।

                          পশ্চান্মুক্তো ভবেৎ পাপাদিত্যাহ কমলোদ্ভবঃ ॥

একাদশীতে সকল প্রকার মহাপাপ অন্নকে আশ্রয় করিয়া থাকে। যে-মন্দবুদ্ধি ব্যক্তি একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, সে ইহলোকে মহাপাপী বলিয়া পরিগণিত হয় এবং মৃত্যুর পরে একাদশী পরিমিত সংখ্যক যুগকাল কুম্ভীপাক নামক নরকে অবস্থান করত চ-াল-যোনিতে জন্মগ্রহণ করে ও সপ্তজন্ম পর্য্যন্ত গলিত কুষ্ঠ-ব্যাধিতে বহু যন্ত্রণা ভোগের পর মুক্ত হইতে পারে- ইহা ব্রহ্মা বলিয়াছেন।


শ্রীএকাদশীর আবির্ভাবের তথ্য অবগত হইতে পারিলে আমরা ইহার আবশ্যকতা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিব। শ্রীপদ্মপুরাণে (ক্রিয়াযোগসার, ১৪ অধ্যায়) দৃষ্ট হয়, যথা-এক সময় জৈমিনি ঋষি নিজ গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন,-

                        কস্মাদেকাদশী জাতা তস্যাঃ কো বা বিধি দ্বিজ।

                         কদা বা ক্রিয়তে কিম্বা ফলং কিম্বা বদস্ব মে ॥

                         ক বা পূজ্যতমা তত্র দেবতা সদ্গুণার্ণবঃ। 

                         অকুর্ব্বতঃ স্যাৎ কো দোষ এতন্মে বক্তুমর্হসি ॥

অর্থাৎ, জৈমিনি কহিলেন,-হে গুরুদেব ! একাদশী-দেবী কখন ও কাঁহার নিকট হইতে উৎপন্না হইলেন, তাঁহার উপবাসের বিধি কি, কখন বা এই ব্রত করিতে হয় এবং উহার ফলই বা কি, তাহা বর্ণনা করুন; আর ঐ ব্রতের পূজ্যতম সদ্গুণসম্পন্ন দেবতাই কে এবং এই ব্রতাচরণ না করিলে দোষই বা কি হয়, সে-সকল বিষয়ও একমাত্র আপনিই বলিতে সমর্থ, কৃপাপূর্ব্বক আমাকে বলুন।


জৈমিনির প্রশ্নের উত্তরে শ্রীব্যাসদেব আনন্দভরে ভগবৎকথা বর্ণনা করিতে লাগিলেন,-বিশ্বসৃষ্টির প্রারম্ভে স্বয়ং ভগবান সংসারে স্থাবর-জঙ্গম সৃষ্টি করিয়া মর্ত্ত্যলোকবাসী মানবগণের শাসন নিমিত্ত একটি পাপপুরুষ (পাপমূর্ত্তি) নির্ম্মাণ করিলেন। সেই পাপমূর্ত্তির অঙ্গসকল পাপ দ্বারাই নির্ম্মিত হইল, অর্থাৎ ব্রহ্মহত্যা-তাহার মস্তক, মদ্যপান-চক্ষুদ্বয়, স্বর্ণ-অপহরণ-মুখ, গুরুপত্নী (বিমাতা)গমন-কর্ণদ্বয়, স্ত্রীহত্যা-নাসিকাদ্বয়, গোহত্যাপাপ-বাহুযুগল, ধন অপহরণ-গ্রীবা, ভ্রুণহত্যা(গর্ভস্থ শিশুবধ)-গলদেশ, পরস্ত্রী-গমন-বক্ষদেশ, আত্মীয়-স্বজনবধ-উদর, শরণাগত-বধ-নাভিদেশ, আত্মশ্লাঘা-কটিদেশ, গুরুনিন্দা-উরুদ্বয়, কন্যা-বিক্রয়-শিশ্ন, গুপ্তকথা প্রকাশ-মলদ্বার, পিতৃহত্যা-চরণদ্বয়, উপপাতক সকল-তাহার রোমাবলী; এইভাবে সমস্ত পাপদ্বারা বিশাল দেহের এক ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্ম্মিত হইল। 


নিজসৃষ্ট মহাকায় পাপপুরুষের এইপ্রকার ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দর্শন করিয়া জীবদুঃখ-মোচনকারী ভগবান চিন্তা করিতে লাগিলেন। অতঃপর ভগবান বিষ্ণু গরুড়ে আরোহণ করিয়া যম-মন্দিরে গমন করিলেন। যমরাজ তাঁহাকে উপযুক্ত স্বর্ণসিংহাসনে উপবেশন করাইয়া পাদ্যাদি দ্বারা তাঁহার যথাবিধি পূজা করিলেন।


যমরাজের সহিত কথোপকথন-কালে পুরুষোত্তম ভগবান দক্ষিণ দিকে ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণে উহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। যমরাজ উত্তরে বলিলেন-‘হে দেব ! পাতকী মর্ত্ত্য-জীবগণ নিজ কর্ম্মদোষে অত্যন্ত দুঃখজনক নরক ভোগ করিতেছে।’ ইহা শ্রবণ করিয়া শ্রীকৃষ্ণ সহসা তথায় উপস্থিত হইলেন। সেই মর্ত্ত্যবাসী পাপাচারী মানবগণকে যন্ত্রনায় পীড়িত দর্শন করত তাঁহার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইল। তাই তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন,-‘আমিই এই সকল প্রজা সৃষ্টি করিয়াছি, আর সর্ব্বশক্তিমান্ আমি বর্ত্তমান থাকিতে ইহারা নিজ কর্ম্মদোষে অত্যন্ত দুঃখদায়ক এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতেছে।’ এই মনে করিয়া তিনি নিজেই একাদশী-তিথি রূপা মূর্ত্তি ধারণ করিলেন। প্রমাণ-স্বরূপে নিম্নলিখিত শাস্ত্রবাক্য উল্লেখ করা যাইতেছে,-

                         এতচ্চান্যচ্চ বিপ্রর্ষে বিচিন্ত্য করুণাময়ঃ।

                          বভূব সহসা তত্র স্বয়মেকাদশীতিথিঃ ॥

                          ততস্তান্ পাপিনঃ সর্ব্বান্ করয়ামাস তদ্ব্রতম্ ।

                          তে চ সর্ব্বে পরং ধাম যযুর্গলিতকল্মষাঃ ॥

                          তস্মাদেকাদশীং মূর্ত্তি বিদ্ধি পরমাত্মনঃ।

                          সমস্ত সুকৃতি-শ্রেষ্ঠাং ব্রতানামুত্তমঃ দ্বিজ ॥

অর্থাৎ, করুণাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করিয়া সেই স্থানেই সহসা নিজে একাদশী তিথিরূপ 

মূর্ত্তিধারণ করত আবির্ভাব হইলেন। তারপর সেইসকল পাপিগণকে তিনি একাদশী-ব্রত আচরণ

 করাইলেন। তাহারা তৎক্ষণাৎ পাপ-মুক্ত হইয়া পরমধাম বৈকুন্ঠে গমন করিলেন। সুতরাং হে বৎস জৈমিনি ! তুমি একাদশী-তিথিকে পরমাত্মা বিষ্ণুর মূর্ত্তি বলিয়াই জানিবে। সমস্ত সুকর্ম্মের শ্রেষ্ঠ ও ব্রত-সকলের উত্তম এই একাদশী ত্রিভুন পবিত্র করিয়া থাকেন। 


এইরূপে কিছুকাল অতীত হইবার পর ভগবৎ-সৃষ্ট সেই পাপপুরুষ বিষ্ণু সমীপে গমন-পূর্ব্বক বদ্ধাঞ্জলি হইয়া সকাতর প্রার্থনা জানাইল, হে ভগবান বিষ্ণো ! আমি আপনার সৃষ্ট প্রজা, আমাকে আশ্রয়কারী (পাপাচারী) জনগণের কর্ম্মানুযায়ী তাহাদিগকে দুঃখদানই আমার কার্য্য ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একাদশী-প্রভাবে আমি ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছি, কারণ ঐ ব্রতের ফলে প্রায় সকলেই বৈকুন্ঠবাসী হইতে চলিল। আমি এখন কাহাকে আশ্রয় করিয়া বর্ত্তমান থাকিব ? আর সকল জীব বৈকুন্ঠে চলিয়া গেলে আপনি কাহার সহিত মর্ত্ত্যে ক্রীড়া করিবেন ? 


অতএব হে কেশব ! একাদশী তিথির ভয় হইতে আমায় রক্ষা করুন। আমি এক একাদশীর ভয়ে পলায়ন করিয়া সমস্ত মনুষ্য, পশু-পক্ষী, কীট, জন্তু, পর্ব্বত, বৃক্ষ, জল, স্থল, নদী, সমুদ্র, বন, প্রান্তর, স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল, দেবতা ও গন্ধর্ব্ব,-ইহাদের সকলকে আশ্রয় করিয়াছি, কিন্তু কোথাও নির্ভয় স্থান পাই নাই দেখিয়া আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। হে দেবদেব ! আপনার সৃষ্ট অনন্তকোটি ব্রহ্মা-মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, সেইজন্য আমি কোথাও আশ্রয় প্রাপ্ত হইলাম না। আপনি কৃপাপূর্ব্বক আমায় একটি নির্ভয় স্থান দান করুন। 

                  

তখন ক্লেশনাশন শ্রীভগবান হাস্যসহকারে তাহাকে বলিলেন,-‘ওহে পাপপুরুষ ! তুমি দুঃখ করিও না। ত্রিভুবন-পবিত্রকারিনী একাদশী-তিথি আবির্ভূত হইলে তুমি অন্ন ও রবি-শস্য প্রভৃতিকে আশ্রয় করিয়া রহিবে, আমার মূর্ত্তি একাদশী তোমায় বধ করিবে না।


সুতরাং একাদশী তিথি মাত্রেই অন্ন ও রবিশস্য মধ্যে পাপপুরুষ অবস্থান করিয়া থাকে, সেই কারণে উক্ত তিথিতে অন্ন ও রবিশস্য ভোজন নিষেধ।


কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.