একাদশী-ব্রতপালনের উদ্দেশ্য
একাদশী-ব্রতোপবাসের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হইতেছে ভগবান শ্রীহরির প্রতি প্রেমভক্তি-লাভ।
ধর্ম্মোপরি মতির্নিত্যং কৃষ্ণে ভক্তিঃ সুনির্ম্মলাঃ।
পাতকৈর্নৈব লিপ্যেত দ্বাদশীভক্তিতো নরঃ ॥ (স্কন্দ পুরাণ)
“শুদ্ধভক্ত-সঙ্গে এই ব্রতাচরণে চতুবর্গের প্রতিও তুচ্ছবুিদ্ধ জাগ্রত হইয়া শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সুনির্ম্মলা ভক্তি লাভ হয়”। সাধারণ মানব হরিভক্তির অতুল মহিমা বুঝিতে পারে না। কিন্তু
হরিভক্তি-মহাদেব্যাঃ সর্ব্বা মুক্তাদিসিদ্ধয়ঃ।
ভুক্তয়শ্চাদ্ভুতাস্তস্যাশ্চেটিকাবদনুব্রতাঃ ॥ (নারদীয় পঞ্চরাত্র)
“এই হরিভক্তিরূপা মহাদেবীর পশ্চাতে সকলপ্রকার মুক্তি, সিদ্ধি ও ভক্তি দাসীর ন্যায় সদা অনুগমন করেন”।
একাদশীব্রতং নাম সর্ব্বকামফলপ্রদম্ ।
কর্ত্তব্যঃ সর্ব্বদা বিপ্রৈর্বিষ্ণু-প্রীণনকারণম্ ॥ (হঃ ভঃ বিঃ ১২/৮)
সুতরাং “সর্ব্বকামফলপ্রদ এই একাদশী-ব্রত কেবল শ্রীবিষ্ণুর তোষণের জন্যই আচরণ করা কর্ত্তব্য”।
গর্গসংহিতার মাধুর্য্যখ-ে বর্ণিত হইয়াছে যে, স্বয়ং ভগবতী শ্রীরাধিকা শরণাগত যজ্ঞসীতা-গোপীগণকে উপদেশ করিয়াছেন,-হে গোপীগণ, তোমরা শ্রীকৃষ্ণকে যদি প্রসন্ন করিতে চাহ, তবে একাদশী-ব্রত কর। ইহাতে তিনি বশীভূত হইবেন, সংশয় নাই- “শ্রীকৃষ্ণস্য প্রসাদার্থং কুরুতৈকাদশী-ব্রতম্।তেন বশ্যো হরিঃ সাক্ষাদ্ ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ॥”
তথাপি শাস্ত্রে একাদশী-ব্রতের ফলস্বরূপে যে পাপমুক্তি, স্বর্গলাভ, মোক্ষপ্রাপ্তি, রোগমুক্তি, দুঃখনিবৃত্তি প্রভৃতি কথিত হইয়াছে, উহার কারণ এই যে, বাস্তবিকই -
চিন্তামণিসমা হ্যেষা অথবাপি নিধিঃ স্মৃতা।
কল্পপাদপপ্রেক্ষা বা সর্ব্ববেদোপমথবা ॥ (নারদীয় পুরাণ)
“এই ব্রত চিন্তামণিস্বরূপ ও কল্পতরু সদৃশ”। সুতরাং এই ব্রত জীবের সর্ব্বপ্রকার কামনা পূরণে সমর্থ। সকামী মানবগণের শুদ্ধভক্তির মহিমা সম্বন্ধে অজ্ঞানতার কারণেই শাস্ত্রসমূহ এই সকল গৌণ-ফলের কথাই সর্ব্বাগ্রে বর্ণনা করিয়া থাকেন। এই সম্বন্ধে শ্রীচেতন্য ভাগবতে (মধ্য ১৯ অধ্যায়ে) স্পষ্টভাবে উক্ত হইয়াছে-
“বেদেও বুঝায় ‘স্বর্গ’ বলে জনা জনা।
মূর্খপ্রতি কেবল সে বেদের করুণা ॥
বিষয় সুখেতে বড় লোকের সন্তোষ।
চিত্ত বুঝি’ কহে বেদ, বেদের কি দোষ ॥
ধন-পুত্র পাই গঙ্গাস্নান-হরিনামে।
শুনিয়া চলয়ে লোক বেদের কারণে ॥
যে তে মতে গঙ্গাস্নান-হরিনাম কৈলে।
দ্রব্যের প্রভাবে ভক্তি হইবেক হেলে ॥
এই বেদ অভিপ্রায়, মূর্খ নাহি বুঝে।
কৃষ্ণভক্তি ছাড়িয়া বিষয়-সুখে মজে ॥”
শ্রীহরিভক্তি বিলাসে শ্রীল সনাতন গোস্বামীর টীকায় ‘স্বর্গ’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হইয়াছে,-“স্বর্গ-শব্দেনাত্রোর্দ্ধ লোকে লক্ষ্যতে, তেন চ শ্রীবৈকুন্ঠপদম” অর্থাৎ স্বর্গ-শব্দে এস্থলে মুখ্যতঃ বৈকুন্ঠপদকেই শাস্ত্রসকল লক্ষ্য করিয়া থাকেন। পুনরায় ‘মোক্ষ’ বলিতেও স্বয়ং শিবঠাকুর শ্রীবিষ্ণুর অনুচরত্ব অর্থাৎ দাসত্বই বুঝাইয়াছেন- “বিষ্ণোরনুচরত্বং হি মোক্ষমাহুর্মনীষিণঃ” (পদ্ম পুরাণ)।
সকল পাপ হইতে নিবৃত্ত হইয়া সর্ব্বগুণগণালয় শ্রীভগবৎ সমীপে বাসই যথার্থ উপাবাস; কেবল আহার বর্জ্জনই উপবাসের তাৎপর্য্য নহে-“উপবৃত্তস্য পাপেভ্যো যস্তু বাসঃ গুণৈ সহ। উপবাস স বিজ্ঞেয়ো নোপবাসস্তু লঙ্ঘনম্ ॥” (ভবিষ্যোত্তর পুরাণ)

কোন মন্তব্য নেই