একাদশী-মাহাত্ম্য
সমগ্রশাস্ত্রই একাদশী ব্রতের অতুলনীয় মাহাত্ম্য মুক্তকন্ঠে ঘোষনা করিয়াছেন। এইস্থলে যৎকিঞ্চিৎ মাহাত্ম্য প্রদর্শিত হইল মাত্র।
একাদশীং পরিত্যজ্য যোহ্নন্যব্রতমুপাসতে।
স করস্থং মহারত্নং ত্যক্তা লোষ্ট্রং হি যাচতে ॥(তত্ত্বসাগর)
“একাদশী ব্রত পরিত্যাগ করিয়া অন্য ব্রতের অনুষ্ঠান করিলে হস্তগত মণি বর্জ্জন করিয়া পাথর কুড়ানোই সার হয়।”
একাদশীব্রতাদন্যদ্যদ্ব্রতং ক্রিয়তে নরৈঃ।
তৎফলং তদ্বিজানীয়াদ্দুঃখোদ্ভূতমিবাঙ্কুরম্ ॥ (হঃ ভঃ বিঃ ১২/১৭৮)
“এই ব্রত বর্জ্জন করিয়া অন্যসব ব্রতাচরণে প্রকৃতপক্ষে সুখী না হইয়া পরিশেষে ঐ সমস্ত ব্রতফল হইতে দুঃখের অঙ্করই উদিত হয়।”
ন দানং ন তপঃ স্নানং ন চান্যৎ সুকৃতং ক্বচিৎ।
মুক্তয়ে হ্যভবৎ সুভ্রু মুক্তৈ¦কং হরিবাসরম্ ॥ (স্কন্দ পুরাণ)
বস্তুতঃ “হরিবাসর ব্যতীত দান, তপস্যা, তীর্থস্থান কিংবা কোনরূপ পুণ্যাচরণ দ্বারা মুক্তিলাভ হয় না।”
একতঃ ক্রতবঃ সর্ব্বে সর্ব্বতীর্থতপাংসি চ।
মহাদানানি দত্তানি ব্রতং বৈষ্ণবমেকতঃ ॥
বৈষ্ণবব্রতজো ধর্ম্মো ধর্ম্মো যজ্ঞাদিসম্ভবঃ।
একত্র তুলিতো ধাত্রা তৎপূর্ব্বো হ্যভবদ্ গুরুঃ॥ (পদ্ম পুরাণ)
“একদিকে অশ্বমেধ, রাজসূয়, প্রভৃতি সকল যজ্ঞ, সকল তীর্থ, সকল তপস্যা ও যাবতীয় মহাদান এবং অন্যদিকে এক বৈষ্ণবব্রত- এইরূপে ব্রহ্মা তুলাদ-ে উভযকে তুলনা করিয়াছেন, তাহাতে হরিনামকারী বৈষ্ণবগণের ব্রতই ওজনে অধিক হইল।”
যথা দাবাগ্নিরুদিতঃ শুষ্কমার্দ্রঞ্চ গহ্বরে।
দহত্যেব সমস্তানি কলুষানি হরের্দ্দিনম্ ॥ (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুবাণ)
“দাবানলের উদয় হইলে যেমন কি শুষ্ক, কি আর্দ্র সকল কাষ্ঠ ভস্মীভূত হইয়া যায়, তদ্রুপ শ্রীহরিবাসর-ব্রতে জীবের পূর্ব্বাপর সকল পাপ বিনষ্ট হয়।”
একাদশ্যামভুঞ্জা যুক্তাঃ পাপশতৈরপি।
ভবদ্ভিঃ পরিহর্ত্তব্যা হিতা মে যদি সর্ব্বদা ॥(স্কন্দ পুরাণ)
“শ্রীযমদেব পর্য্যন্ত তাঁহার দূতগণকে সাবধান করিয়া দেন,-যদি আমার ভাল চাহ, তবে শত পাপ করিলেও একাদশী-ব্রতোপবাসকারিগণকে তোমরা পারহার করিয়া চলিবে।”
সর্ব্বপ্রায়শ্চিত্তমিদং সংসারোত্তারকারকম্।
একাদশীব্রতং বিপ্র কুর্ব্বন মুক্তিমবাপ্নুয়াৎ ॥ (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ)
বস্তুতঃ “এই ব্রতোবাসই সকল পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপা এবং সংসার মোচনকারী।”
একাদশীব্রতং যস্তু ভক্তিমান্ কুরুতে নরঃ।
সর্ব্বপাপবিনির্ম্মুক্তঃ স বিষ্ণোর্যাতি মন্দিরম্ ॥(বায়ু পুরাণ)
সুতরাং “যথার্থ ভক্তিসহকারে একাদশী ব্রতাচরণে সকল পাপ হইতে পরিত্রাণ পাইয়া এমনকি বিষ্ণুমন্দিরে গমন হইয়া থাকে।”
এতচ্ছৃণোতি কুরুতেহ্ননুমতিং দদাতি শ্রদ্ধাঞ্চ কারয়তি যশ্চ তথা নরাণাম্।
একাদশীব্রতকৃতে কলুষৈর্বিমুক্তঃ প্রাপ্নোতি দিব্যভুবনং গরুড়ধ্বজস্য ॥ (ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ)
“একাদশী ব্রতকথা শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ করিলে, ইহার অনুষ্ঠান করিলে, ইহার অনুষ্ঠানে অনুমতি দিলে এবং অন্য অজ্ঞ জীবগণের হৃদয়ে এই ব্রত সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগ্রত করাইলে সকল পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া গরুড়ধ্বজ ভগবান বিষ্ণুর দিব্যধামে গতিলাভ হইয়া থাকে।”
সর্ব্বতিথি-শ্রেষ্ঠা শ্রীএকাদশী সর্ব্বপ্রথমেই ব্রতপারায়ণ ব্যক্তিকে হরিভক্তি প্রদান করেন এবং আনুষঙ্গিক-রূপে ধর্ম্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রভৃতি অবান্তর ফলও দিয়া থাকেন। নিম্নো এক পুরাতন কাহিনী উল্লিখিত হইতেছে-
পূর্ব্বকালে ‘কোটিরথ’ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পরম ধার্ম্মিক, রাজনীতিজ্ঞ, সত্যবাদী, ক্রোধজয়ী, নারায়ণপূজক ও হরিবাসর-ব্রতনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁহার পত্নী সুপ্রজ্ঞাও প্রিয়দর্শিনী ও সর্ব্ব সুলক্ষণযুক্তা নারী ছিলেন। তাঁহারা উভয়ে একদিন একাদশী-তিথিতে উপবাস সহ বিষ্ণুপূজারত থাকিয়া নৃত্য-গীতে রাত্রিযাপন করিতেছিলেন। এমন সময় ‘শৌরি’ নামক এক ব্রাহ্মণ তথায় আসিয়া উপস্থিত হন এবং তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন,-হে রাজন ! আপনারা ধন্য। আপনাদের ন্যায় বৈষ্ণব জগতে দুর্ল্লভ। আপনাদের এই বুদ্ধি কিরূপে জন্মিল ?
ব্রাহ্মণের বাক্য শ্রবণ করিয়া জাতিস্মরা রানী বলিতে লাগিলেন,-“আমরা পূর্ব্বজন্মে মহাপাতকী ছিলাম, কিন্তু একাদশী-ব্রত প্রভাবে যমরাজের কঠোর হস্ত হইতে মুক্ত হইয়াছি। যদিও ইহা অপ্রকাশ্য, আপনি বৈষ্ণবোত্তম বলিয়া আপনার নিকট বর্ণন করিব। আমি ‘ছিত্রপদা’ নাম্নী বেশ্যা ছিলাম এবং বহুবিধ পাপাচরণ করিয়াছিলাম্ এই রাজাও সর্ব্বপ্রকার আচারহীন, দস্যু, পরস্ত্রীগামী, মিথ্যাভাষী, অহঙ্কারী ও ধর্ম্মনিন্দুক ‘নিত্যদয়’ নামক এক শুদ্র ছিলেন। তাঁহার অনাচারের জন্য তিনি সমস্ত জাতি-বন্ধু-বান্ধব কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া আমার আশ্রয়ে বাস করিতেন। সেই হইতে আমরা উভয়ে স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় কালযাপন করিতে থাকি। একদিন কোন এক একাদশী তিথিতে আমি জ্বরাক্রান্ত হইয়া রোগ-যন্ত্রণায় ‘হে হরি, হে গোবিন্দ, হে নারায়ণ! আমাকে রক্ষা করুন’ -এই বলিয়া কাতরভাবে চিৎকার করিতে করিতে ঘৃতের প্রদীপ জ্বালাইয়া সেই রাত্রি জাগরণ করি। আমার প্রতি প্রীতিবশতঃ এই রাজাও অন্নাদি আহার না করিয়া সেই নিশিতে সঙ্গী ছিলেন। পরদিন প্রভাতে আমার মৃত্যু হয় এবং ইনিও দৈবক্রমে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন। তৎপরে যমদূতগণ আমাদের উভয়কে দুর্গমপথে যমালয়ে লইয়া যায়। সেখানে ধর্ম্মাধর্ম্ম হিসাব-রক্ষক চিত্রগুপ্ত যমরাজকে বলিলেন,-“ইহারা মহাপাতকী হইলেও একাদশী-ব্রত প্রভাবে সর্ব্বপাপমুক্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি অনিচ্ছা সত্ত্বেও একাদশী উপবাস করে, সে সর্ব্ব পাপশূন্য হইয়া পরমধাম বৈকুন্ঠে গমন করে।” চিত্রগুপ্তের বাক্য শ্রবণ করত যমরাজ তখন আমাদিগকে পূজোপকরণ-দ্বারা অর্চ্চন পূর্ব্বক আহার করাইয়া প্রীত করিলেন এবং তদনন্তর দিব্যরথে উপবেশন করাইয়া বলিলেন,-“আপনারা পুণ্যবন্তগণের মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। যে স্থানে ভগবান বিষ্ণু বিরাজ করেন, তথায় আপনারা গমন করুন।”

কোন মন্তব্য নেই