অপরাধ চার প্রকার

     


ক) নামাপরাধ - কৃষ্ণনামে অপরাধ। অপরাধ হচ্ছে সচেতনভাবে হৃদয়স্থ অশুদ্ধ, বৈরী ভাবের সঙ্গে দিব্য নাম উচ্চারণ। সেটিই হচ্ছে সবচেয়ে নিম্নমানের জপ, যেখানে জপকারী দশটি নামাপরাধের এক বা একাধিক নাম অপরাধ করে থাকেন। যতদিন অপরাধযুক্ত জপ করা হয়, ততদিন ভগবৎ প্রেম লাভ সম্পূর্ণ অসম্ভব। 

      সর্বপ্রকার পাপ ও অপরাধের মধ্যে নামাপরাধ সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর। অন্যান্য সকল পাপ হরিনাম উচ্চারণের ফলে স্বাভাবিকভাবে আপনা থেকেই লোপ হয় ; কিন্তু নাম অপরাধ এত সহজে যায় না। 

     নামাপরাধ শব্দের আক্ষরিক অর্থ শ্রীনামকে অবজ্ঞা করা, শ্রীনামের অসন্তোষ উৎপাদন করা। অন্য কথায় শ্রীকৃষ্ণ - যিনি তাঁর নাম হতে অভিন্ন, তাঁর নামাকার চিদরূপের প্রতি আমাদের অপরাধমূলক আচরণে অসন্তুষ্ট বা অসুখী হন। শ্রীকৃষ্ণের নাম তাঁর অভিন্ন শব্দ বিগ্রহ। নামাপরাধ, শ্রীভগবৎ নামের প্রতি অপরাধ। জপকারীর ভগবানের প্রতি প্রেম প্রীতির প্রবাহ প্রতিরুদ্ধ করার মাধ্যমে তার পারমার্থিক সিদ্ধি লাভের প্রতিকূলে কার্য করে, তাঁর আনন্দলাভ, সমৃদ্ধি প্রাপ্ত প্রতিহত করে। 


     শ্রীনামের প্রতি অপরাধের ফলে সাধনভক্তি অনুশীলনে রুচি ও আকর্ষণ চলে যায়, অনাগ্রহ আসে। অন্য কথায় ভক্ত তখন শ্রবণ, কীর্তন, সাধুসঙ্গ এবং শ্রীগুরুদেবের সেবা থেকে কোন সুখ বা আনন্দ পাবেন না। কৃষ্ণভক্তির জগৎ তখন নীরস, একঘেয়ে ও বিস্বাদ মনে হবে। কৃষ্ণের প্রতি বিতৃষ্ণা হচ্ছে আত্মার রোগাক্রান্ত অবস্থা। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যেমন সুচিকিৎসা গ্রহণ করলে শীঘ্রই আহারে রুচি ফিরে পায়, তেমনি নামাপরাধী যদি অপরাধ সংশোধন করে নিরন্তর নাম জপ করতে থাকে, তাহলে তার বিচ্যুতি জনিত ভুলগুলি বিদুরিত হয়ে যায় এবং নামে পুনরায় রুচি ফিরে আসে। 

            নামাপরাধযুক্তনাং নামান্যেব হরন্তঘম্।

            অবিশ্রান্তি প্রযুক্তানি তান্যেবার্থ করানি চ॥

   হরিনামের প্রতি যারা অপরাধ করে, তাদেরও হরেকৃষ্ণ নাম জপের বিধান দেওয়া হয়েছে ; কারণ তারা যদি নিরন্তর জপ করে চলে, ক্রমে ক্রমে তারা নিরাপরাধ জপ করতে পারবে। শুরুতে যদিও অপরাধ, তবুও পুনঃ পুনঃ জপের ফলে সেই সব অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যায় এবং নামে পুনরায় রুচি ফিরে আসে। 

                                     (পদ্ম পুরাণ স্বর্গখন্ড ৪৮-৪৯)

  যদিও একজন ভক্ত অপরাধ বর্জনের চেষ্টা করে থাকেন, তবুও তিনি অসহায়, তিনি একাকী তা করতে পারেন না। ভক্তি, কৃষ্ণ নামের শক্তি এবং কৃষ্ণের পার্ষদগণের কৃপার মাধ্যমেই কেবল নামাপরাধ থেকে মুক্ত হতে পারেন। দশবিধ নামাপরাধ হল -

(১) যে সমস্ত ভক্ত ভগবানের দিব্য নাম প্রচার করার জন্য নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের নিন্দা করা।

(২) শিব ব্রহ্মা আদি দেবতাদের নাম ভগবানের নামের সমান অথবা তা থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করা। 

(৩) শ্রীগুরুদেবকে অবজ্ঞা করা।

(৪) বৈদিক শাস্ত্র অথবা বৈদিক শাস্ত্রের অনুগামী শাস্ত্রের নিন্দা করা।

(৫) ‘হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তন করার মাহাত্মকে কাল্পনিক বলে মনে করা।

(৬) ভগবানের নামের অর্থবাদ আরোপ করা।

(৭) নাম বলে পাপ আচরণ করা। 

(৮) হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র উচ্চারণ করাকে বৈদিক কর্মকান্ডে বর্ণিত পুণ্য কর্ম বলে মনে করা।

(৯) শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিকে ভগবানের দিব্য নামের মহিমা সম্বন্ধে উপদেশ করা।

(১০) ভগবানের নামের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস না থাকা এবং তাঁর অগাধ মহিমা শ্রবণ করার পরেও বিষয়াসক্তি বজায় রাখা।


  প্রতিটি বৈষ্ণব ভক্তেরই কর্তব্য হচ্ছে, ঈপ্সিত সিদ্ধি লাভ করার জন্য এই সমস্ত অপরাধগুলি থেকে মুক্ত হওয়া।


      দশ প্রকার নামাপরাধ বর্জনের আজ্ঞা বা নির্দেশের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সদর্থক বা সহায়ক গুণাবলীর বিকাশ সাধন ও উপলব্ধি অর্জন - যা ভক্তকে পুনরায় অপরাধ করা থেকে রক্ষা করে। হরিনাম চিন্তামনি গ্রন্থে দশটি ক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে (যাদের আমরা বলছি দশটি প্রতিরোধ), যা অপরাধ করার প্রবণতা থেকে রক্ষা করে। দৃঢ়বতী ভক্তের উচিৎ এই ক্রিয়া গুলিকে তার দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গীভূত করে নেওয়া, যাতে দ্রুত শুদ্ধ নাম জপের স্তরে উন্নীত হওয়া যায়।


প্রথম প্রতিরোধ - বৈষ্ণবগণের সেবা ; তাঁদের নিন্দা বা সমালোচনা নয়। ভক্ত নিজেকে সব সময়ই দীন হীন পতিত বিবেচনা করবেন। সেজন্য তিনি কাউকে ঈর্ষা করেন না, কারো নিন্দা করেন না। বরং তিনি সকল জীবের সেবা করেন, তাদেরকে ভগবানের নিকট ফিরে য়েতে সহায়তা করেন।


দ্বিতীয় প্রতিরোধ - পরম মনোহর ব্রজসুন্দর বৃন্দাবনবিহারী শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করুন। ভক্ত কখনও স্বতন্ত্র ভাবে দেবগণের আরাধনা করেন না, কারণ তিনি পূর্ণরূপে অবগত যে দেবগণসহ সকল জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাস এবং তাঁর আশ্রিত।   


তৃতীয় প্রতিরোধ - ভক্তের উচিৎ যিনি তাঁকে দিব্য নামে দীক্ষিত করেছেন, সেই গুরুদেবের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হওয়া। ভক্ত কখনো গুরুদেবের নির্দেশ বা গুরুদেবের আজ্ঞা লঙ্ঘন করেন না, কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে গুরুকৃপা ব্যতীত কখনই শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা যায় না।  


চতুর্থ প্রতিরোধ - দিব্য নামের মাহাত্ম্য প্রকাশক শাস্ত্র সমূহের ভক্ত আন্তরিক ভাবে প্রশংসা করবেন। কেবল শাস্ত্র চক্ষুর দ্বারাই পরমার্থ তত্ত্ব দর্শন করা যায়। এটি উপলব্ধি করে ভক্ত পবিত্র গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করেন, পূজা করেন এবং সেগুলির শিক্ষা প্রচার করেন।


পঞ্চম প্রতিরোধ - এই বিশ্বাসে সম্পূর্ণ সুদৃঢ় হতে হবে যে দিব্যনাম নিত্যকাল শুদ্ধ অপ্রাকৃত স্তরে স্থিত। ভক্ত প্রত্যক্ষ ভাবে দিব্য নামের অচিন্তনীয় শক্তি অনুভব করে থাকেন। সেজন্য তিনি কখনই নাম মাহাত্ম্যকে অতিরঞ্জন বা অতিস্তুতি মনে করেন না।


ষষ্ঠ প্রতিরোধ - শাস্ত্রে সাধু ঋষিগণের প্রদত্ত দিব্য নামের ব্যাখ্যায় ভক্ত পূর্ণরূপে বিশ্বাসী হবেন। ভক্ত নামের অর্থবাদ করেন না, কারণ তিনি নামতত্ত্ব ভাল ভাবে অবগত।  


সপ্তম প্রতিরোধ - পাপ বাসনার মূলোৎপাটন করুন। ভক্ত কখনো নামবলে পাপ করার চিন্তা করেন না, কারণ তিনি দেহাত্ম বুদ্ধি ও জড় সুখ পরিহার করেছেন। 


অষ্টম প্রতিরোধ - কর্ম কান্ডীয় পুণ্য কর্ম বা সৎকর্ম  পরিত্যাগ করা উচিত। ভক্ত পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন যে, শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত নামের সেবাই হচ্ছে তার একমাত্র কৃত্য। 


নবম প্রতিরোধ - কেবল শ্রদ্ধাবান মানুষদের কাছে দিব্য নামের মহিমা প্রচার করা উচিত। সংবেদনশীল সুবিজ্ঞ ভক্ত কখনো ‘উলুবনে মুক্ত’ ছড়াবেন না। 


দশম প্রতিরোধ - পূর্ণভাবে দিব্য নামের আশ্রয় গ্রহণ করে মনোযোগের সঙ্গে জপ করা উচিত। শ্রদ্ধাবান ভক্তের দিব্য নামের প্রতি  পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। তিনি সর্বদাই অবৈধ কামনারূপ আগাছার মূলোৎপাটন করে তাঁর জপের মান বৃদ্ধি করতে চান। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সাধক প্রতি মুহূর্তে সর্বাকর্ষক প্রভু শ্রীকৃষ্ণের চরণ প্রান্তে শরণাগত হওয়ার সাথে সাথে উৎসাহের সঙ্গে ভক্তি পথে অগ্রসর হন। 


     খ) সেবা অপরাধ - কৃষ্ণ স্বরূপে অপরাধ,


     গ) বৈষ্ণব অপরাধ - ভগবদ্ভক্তের চরণে অপরাধ। প্রত্যেক ভক্তের স্বরূপ লক্ষণ হচ্ছে পূর্ণ শরণাগতি, যা কমবেশি মাত্রায় তাঁর মধ্যে প্রকাশিত। তটস্থ লক্ষণ যেমন সহিষ্ণুতা (ক্ষান্তি), ক্ষমাশীলতা, করুণা, বিনয়, স্থৈর্য্য, দয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন ভক্তে বিভিন্ন পরিমাণে এই সব গুণাবলী থাকে। সে জন্য কোন ভক্তকে কখনই ঐগুলি বিচার করে সমালোচনা করা উচিত নয় - (১) সামাজিক অবস্থা বা জাতি-কুল, (২) অতীতের অর্থাৎ ভক্ত হবার পূর্বেকার পাপ বা বিচ্যুতি, (৩) অনিচ্ছাকৃত পাপ বা আকস্মিক পতন। 


     বৈষ্ণব অপরাধের প্রধান কারণ হচ্ছে অসৎ সঙ্গ, জড় বিষয়াসক্ত মানুষের সঙ্গ, যার প্রভাবে ভক্তদের চিত্ত কলুষিত হয়ে যাওয়ায় ভক্তদের প্রতি ঈর্ষা বা মৎসরতার উদয় হয়। তঁদেরকে জড় বুদ্ধিতে বিচার করা ও তাদের ত্রুটি বিচ্যুতি অন্বেষণ করার প্রবণতা জন্মে। জপে ত্রুটি শূন্যতা, স্বার্থক অর্জনের জন্য নিষ্ঠাবান ভক্তদের উচিত সকল ধরনের অসৎ সঙ্গ - বিষয়ী সঙ্গ পরিহার করা। 


     একজন বৈষ্ণবের কর্তব্য কি এই বিষয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তিনি তৎক্ষণাৎ বলেন -

অসৎসঙ্গ ত্যাগ এই বৈষ্ণব আচার। 

 ‘স্ত্রীসঙ্গী’ এক অসাধু কৃষ্ণাভক্ত আর॥


বৈষ্ণকে সর্বদাই অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। স্ত্রীর প্রতি আসক্ত এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিহীন ব্যক্তিরাই অসাধু। এই অসৎ সঙ্গ ত্যাগই বৈষ্ণব আচার। 


   শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এখানে দুই শ্রেনীর অসৎ সঙ্গের উল্লেখ করেছেন - (১) স্ত্রীসঙ্গের প্রতি আসক্ত মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ, যোষিৎ সঙ্গীর সঙ্গ ত্যাগ। (২) কৃষ্ণাভক্ত (কৃষ্ণ+অভক্ত) - চার ধরনের অভক্তের সঙ্গ পরিত্যাগঃ মায়াবাদী, নাস্তিক, মৎসরতা পরায়ণ, ইন্দ্রিয় ভোগী এবং ভক্তরূপী ভক্ত বিষয়ী (প্রাকৃত ভক্ত বা সহজিয়া)।


     বৈষ্ণব অপরাধের মধ্যে শরীর, বাক্য, মন ও চিত্তের ক্রিয়া কলাপের অন্তর্ভূক্ত। বৈষ্ণবকে দর্শন করে উল্লসিত না হওয়া অপরাধ এবং এটি হৃদয় ঈর্ষা - মৎসরতায় কলুষিত থাকার লক্ষণ। মৎসরতাপূর্ণ চিত্তই এই অপরাধের উদ্ভব স্থল। স্কন্ধ পুরাণে এই রকম ছয় ধরনের অপরাধ বর্ণিত হয়েছে -


         হন্তিনিন্দতি বৈ দ্বেষ্টি বৈষ্ণবান্নাভিনন্দতি।

        ক্রুধ্যতে যাতি নো হর্ষং দর্শনে পতনানি ষট্॥ 

  

   (১) যে ভক্তকে হত্যা করে, (২) যে ভক্তের নিন্দা করে, (৩) যে ভক্তকে দ্বেষ অর্থাৎ হিংসা করে, (৪) যে বৈষ্ণবকে দর্শন করে তার অভিনন্দন(প্রণাম, পূজা ) না করে, যে বৈষ্ণবের প্রতি ক্রোধ করে, (৬) ভক্ত দর্শনে যে আনন্দিত না হয়। এই ছয় ধরনের বৈষ্ণবদ্বেষী মূঢ়রা তাদের বহু বহু প্রজন্মের পিতৃপুরুষগণ সহ মহারৌরব নরকে অধঃপতিত হয়। 


   অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ করে, তাঁর নিন্দা করে স্বস্তি পাবার চেষ্টা করে ; এইভাবে বৈষ্ণব অপরাধ হয, ঐ বৈষ্ণবের প্রতি সে অস্তরে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কেবল মাত্র ঐ বৈষ্ণবের প্রতি তাঁর মৎসরতা থাকার ফলেই নিন্দা ও সমালোচনার উৎপত্তি হয়। আর সেজন্য বৈষ্ণব সম্পর্কে খারাপ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। ভজন পথাবলম্বী সাধকের পক্ষে অন্যের নিন্দা বা সমালোচনা এক মহা অনর্থ স্বরূপ।


      শ্রীমদ্ভাগবতের ভাষ্যে শ্রীধর স্বামী বলেন,“নিন্দনং দোষকীর্তন” - সত্যি হোক বা না হোক, সাধুর দোষ ত্রুটি কীর্তন বৈষ্ণব অপরাধ। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৭৪/৪০) সতর্ক করা হয়েছে যে, ভক্ত নিন্দা শ্রবণের ফলে নরকে গতি লাভ হয় -


      নিন্দাং ভগবতঃ শৃন্বাংস্তৎপরস্য জনস্য বা।

     ততো নাপৈতি যঃ সোহপি যাত্যধঃ সুকৃতাচ্যুতঃ॥


  অর্থাৎ যে স্থানে পরমেশ্বর ভগবান কিংবা তাঁর অনুগত ভক্তের নিন্দা শ্রুত হয়, কেউ যদি তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান পরিত্যাগ না করে তা হলে তার সকল সুকৃতি বিনষ্ট হয়। সে নরকে অধঃপতিত হয়।


      বৈষ্ণব নিন্দুকেরা শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করতে পারে না। তাছাড়া ভগবানের শ্রীচরণ কমলে শুদ্ধ প্রেমভক্তি লাভ করতে পারে না। বৈষ্ণব নিন্দার ফলে শুদ্ধ নাম উচ্চারণ হয় না। সেজন্য কখনই বৈষ্ণব নিন্দা করা উচিক নয়। যাঁরা অনিন্দুক, কারো নিন্দা করে না, তাঁরা যদি কেবল একবার মাত্র শ্রীকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করেন, কৃষ্ণ তাঁদেরকে উদ্ধার করেন। 


     ঘ) জীব অপরাধ - যে কোন জীবসত্তার প্রতি অপরাধ। 

 মহাভারতে বলা হয়েছে - “ যে মানুষ অন্য কোন জীবকে উত্যক্ত করে না অথবা ক্লেশ দেয় না , যিনি সকলকে পুত্রবৎ দর্শন করেন, যাঁর হৃদয় নির্মল, তিনি অচিরেই পরমেশ্বর ভগবানের কৃপা লাভ করেন। 


     আজকের তথাকথিত সভ্য সমাজে কখনও কখনও পশু হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়, কিন্তু কসাইখানা গুলিতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নিরীহ প্রানীকে হত্যা করা হচ্ছে। বৈষ্ণবের মনোভাব সেরকম নয়, বৈষ্ণব কখনই পশু হত্যা বরদাস্ত করেন না এবং তিনি কখনই কাউকে ক্লেশ দেন না। 


    “মা হিংসাৎ সর্বানি ভূতানি” - এই বেদবাক্যের দ্বারা পশু হিংসা নিষেধ করা হয়েছে। যে কোন জীবসত্তা - এমনকি পিঁপড়ে, মাছি বা কুকুরদের প্রতিও হিংসা অপরাধ। পশু হিংসা সামান্য পাপ নয়। উদার পরায়ণ ব্যক্তিগণ স্বার্থ বশতঃ যে পশু হিংসার বিধান করে, তা কেবল মানবের অপতৃষ্ট পাশব প্রবৃত্তির পরিচালন মাত্র। জীব হিংসা বা অপরাধ হতে বিরত না হলে নর স্বভাব উজ্জল হয় না। যে কার্যে জীব হিংসা আছে তা ভক্তির প্রতিকূল। পর হিংসা সর্ব পাপের মূল, সুতরাং পাপ অপেক্ষা অধিক গুরুতর । যাঁরা ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণভক্তিতে প্রবৃত্ত হন, তাঁদের স্বভাবত পরহিংসা প্রবৃত্তি থাকে না। তাই তাঁরা জীব অপরাধ থেকে মুক্ত থাকেন। দ্বেষ হতে হিংসার উৎপত্তি হয়। অন্য কোন জীবকে উপদ্রব বা হত্যা করা অনুচিত কার্য। কোন ভোগ্য বিষয়ে আসক্তি করার নামই - রাগ এবং কোন বিষয়ে বিরক্তি করার নামই দ্বেষ। উচিত রাগ পুণ্য মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। অনুচিত রাগকে লাম্পট্য বলে। দ্বেষ রাগের বিপরীত ধর্ম। উচিত দ্বেষকেও পুণ্য মধ্যে পরিগণিত হয়। কিন্তু অনুচিত দ্বেষই হিংসা ও ঈর্ষার মূল। সামান্য বিষয় লোলুপ লোকেরা গাড়ীর গরু ও ঘোরাকে যে প্রকারে কষ্ট দেয় তা দেখলে সহৃদয় ব্যক্তির হৃদয় বিদীর্ন হয়।


৩। অসত্তৃষ্ণাঃ

     জড়বস্তুকে অহংমমাদি বুদ্ধি করে অসৎ বিষয়ে সুখাদির তৃষ্ণাকে অসত্তৃষ্ণা বলে। জড়দেহের দ্বারা বিষয় পিপাসাই অসৎ তৃষ্ণা। স্বর্গসুখ, ইন্দ্রিয়সুখ, ধন-জনসুখ সকলই অসৎ তৃষ্ণা। যতদিন পর্যন্ত অপ্রাকৃত তত্ত্বে শুদ্ধ রতির উদয় না হয়, ততদিন পর্যন্ত বিষয় তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে বিগত হয় না। অবসর পেলেই বিষয়ের প্রতি ইন্দ্রিয়গুলি ধাবিত হয়।

কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.