অনর্থ গুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা





১। হৃদয় দৌর্বল্যঃ

    হৃদয় দৌর্বল্য থেকে শোকাদির উদ্ভব হয়। আলস্য ও ইতর বিষয়ের বশীভুতা, শোকাদির দ্বারা চিত্তবিভ্রম, কুতর্কের দ্বারা শুদ্ধভক্তি হতে বিপথগামী হওয়া , সমস্ত জীবনী শক্তি কৃষ্ণানুশীলনে অর্পণ করতে কার্পণ্য, জাতি-ধন-বিদ্যা-জন-রূপ ও বলের অভিমানে গর্বোদ্ধত স্বভাব অঙ্গীকার, অধর্ম প্রবৃত্তি বা উপদেশের দ্বারা চালিত হওয়া, কুসংস্কার শোধনে অযত্ন, ক্রোধ, মোহ, মাৎসর্য ও অসহিষ্ণুতাজনিত দয়া পরিত্যাগ, প্রতিষ্ঠাশা ও শাঠ্যের দ্বারা বৃথা বৈষ্ণবাভিমান, কনক কামিনী ও ইন্দ্রিয় সুখাভিলাষে অন্য জীবের প্রতি অত্যাচার - এই প্রকার কার্য সকলই হৃদয় দৌর্বল্য থেকে উদিত হয়।

     হৃদয দৌর্বল্য বশতঃ অনেক সময়ে ভজন প্রতিকূল ক্রিয়া বা সঙ্গ ত্যাগ করা যায় না। অসৎ কার্যে বা অসৎ সঙ্গে ভক্তিদেবীর প্রতি অপরাধ জন্মে, তাতে ভজন অশুদ্ধ হয়। অতএব হৃদয় দৌর্বল্য ত্যাগ করতঃ ভজনে উৎসাহ প্রকাশ এবং নিরপেক্ষতা রক্ষা করাই বিশুদ্ধ ভজনের সহায়।


       হৃদয় দৌর্বল্য চার প্রকার .......


       ক) তুচ্ছাসক্তি - কৃষ্ণ সম্বন্ধহীন বিষয়ে আসক্তি,


খ) কুটীনাটী - প্রতারণা ও দোষ দর্শনের প্রবণতা। কুটীনাটী শব্দে ‘কু-টী’ ও ‘না-টী’ এই দুটি কথা আছে। শুচিবায়ু গ্রস্ত ব্যক্তিগণ সকল বিষয়েই ‘কু-টী’ দৃষ্টি করেন অর্থাৎ একটি জলাশয়ে ¯œান করলেন কিন্তু কাছে কোন মলক্ষেত্র থাকায় সেই জলাশয়ের কুটী মনে করে সমস্ত দিন সেই আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। কোন ভাল বিষয় আলোচনা করতে পান না। শুচিবায়ু এক প্রকার কুটীনাটীর স্থল। যাদের ঐ প্রকার বায়ু আছে তারা পৃথিবীর কোন স্থানকেই পবিত্র মনে করতে পারে না। কোন সময়কেই শুদ্ধ মনে করতে পারে না এবং কোন ব্যক্তিকেই শুদ্ধ বৈষ্ণব বলে স্বীকার করে না। শুদ্ধ ভক্তের স্মার্ত বিরুদ্ধ কোন আচার দেখলে তারা আর বৈষ্ণব মনে করে সঙ্গ করে না। এস্থলে ‘কু’ টির উপরে ‘না’ টি উপস্থিত হল। নীচ বর্ণের সাধুলোকের প্রতিষ্ঠিত ভগবৎ বিগ্রহের প্রসাদ না পাওয়া একটি কুটীনাটী। কুটীনাটী প্রবল থাকলে কোন খাদ্য দ্রব্যে সুখলাভ হয় না। কুটীনাটী  এক প্রকার মানসিক পীড়া ; সেই পীড়া থাকলে কৃষ্ণভক্তি হওয়া কঠিন। বৈষ্ণব সেবা ও বৈষ্ণব সঙ্গ কুটীনাটী গ্রস্তের পক্ষে বড়ই কঠিন। শ্রীমন্মহাপ্রভুর উপদেশে যে কুটীনাটী পরিত্যাগের বিশেষ পরামর্শ আছে, তাতে কোন স্থলে নিষিদ্ধাচার, জীবহিংসা, প্রতিষ্ঠাশা প্রভৃতি ভক্তিবাধক বস্তুর মধ্যেই কুটীনাটীকে ধরেছেন। মহাপ্রভু কুটীনাটী শব্দের অর্থ - “এই ভাল, এই মন্দ শব্দের দ্বারা করেছেন। কুটীনাটী গ্রস্ত ব্যক্তির বর্ণাভিমান ও সৌন্দর্যাভিমানে মহা মহাপ্রসাদ, ভক্তপদ ধুলিতে ও ভক্তপদ জলে দৃঢ় বিশ্বাস হয় না। তিনি সর্বদা বৈষ্ণব অপরাধ ও নামাপরাধে দোষী। অতএব তাঁর মুখে হরিনাম হওয়া কঠিন। কতগুলি লোক আছেন তাঁরা শুদ্ধ বৈষ্ণবের পীড়া সময়ে ঘৃণা প্রকাশ করেন।

            

       গ) মাৎসর্য - মৎসরতা অর্থাৎ পরশ্রী কাতরতা,


       ঘ) প্রতিষ্ঠাশাঃ - লাভ, পূজা, প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর গেয়েছেন -


         অভ্যাসিয়া অশ্রুপাত,  লম্ফ-ঝম্ফ অকস্মাৎ,

                       মূর্”ছা প্রায় থাকহ পড়িয়া।

            এ লোক বঞ্চিতে রঙ্গ,    প্রচারিয়া অসৎ সঙ্গ,

                কামিনী কাঞ্চন লভ গিয়া ॥ 

 

   আরও পাওয়া যায় -

                 সর্বত্যাগ করিলেও ছাড়া সুকঠিন।    

                 প্রতিষ্ঠাশা ত্যাগে যত্ন পাইবে প্রবীন ॥


যারা শঠ, তারা নিজ স্বভাবকে গোপন করে মহতের স্বভাব অনুকরণ করত প্রতিষ্ঠা লাভ করবার চেষ্টা করে, কিন্তু সেরূপ অনুকরণ স্থায়ী হয় না, দুই চারি দিনের মধ্যে তাদের নিজ স্বভাবের পরিচয় দিতে অবশ্যই বাধ্য হয়। যতদিন প্রতিষ্ঠার আশা ত্যাগ করতে না পারি, ততদিন ‘বৈষ্ণব হয়েছি’ এরূপ মনে করতে পারি না। কেবল কথায় দৈন্য করলে হয় না। আমি বলে থাকি -

“ আমি  বৈষ্ণব দিগের দাসের দাস হবার যোগ্য নই; কিন্তু মনে শ্রোতাগণ এই শুনে আমাকে শুদ্ধ বৈষ্ণব বলে প্রতিষ্ঠা দান করবেন।” হায় ! প্রতিষ্ঠার আশা আমাদেরকে ছাড়তে চায় না। প্রতিষ্ঠার আশা গৃহস্থ লোকের অধিক হবে বলে শান্তি পরায়ণ ব্যক্তিগণ সংসার ছেড়ে ভেক গ্রহণ করে; কিন্তু সেই অবস্থায় আবার প্রতিষ্ঠাশা অধিক বলবতী হয়ে উঠে। প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস সমস্ত প্রয়াস অপেক্ষা হেয়। হেয় হলেও অনেকের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আচার্যের প্রিয়তা ও সাধুমন্ডলীর প্রতিষ্ঠা, সাধারণ লোকের শ্রদ্ধা এবং কালনেমির ন্যায় কার্য উদ্ধারের আশায় ও মহোৎসব সম্মান পাওয়ার জন্য অনেকেই কাপট্য স্বীকার করত ভগবৎ রতির অনুকরণে নৃত্য, স্বেদ, পুলকাশ্রু, গড়াগড়ি, কম্প এবং কখনও কখনও ভাব পর্যন্ত লক্ষণ প্রদর্শন করেন। কিন্তু তাদের হৃদয়ে সাত্ত্বিক বিকার নেই। “ আমি ত’ বৈষ্ণব এবুদ্ধি হইলে অমানী না হব আমি। প্রতিষ্ঠাশা আসি হৃদয় দুষিবে হইব নিরয়গামী ॥


     শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাঁর মনঃশিক্ষা গ্রন্থে প্রতিষ্ঠাকে এক চন্ডালিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন -

           প্রতিষ্ঠাশা ধৃষ্টা শ্বপচরমণী মে হৃদি নটেৎ

           কথং সাধু প্রেমা স্পৃশতি শুচিরেতন্ননু মনঃ।

           সদা ত্বং সেবস্ব প্রভুদয়িত সামন্তমতুলং

          যথা তাং নিষ্কাশ্য ত্বরিতমিহ ত্বং বেশয়তি সঃ ॥


  হে মন ! নির্লজ্জা স্বপচরমনী প্রতিষ্ঠা আমার হৃদয়ে নৃত্য করছে, তখন নির্মল সাধু প্রেম সে হৃদয়কে কেন স্পর্শ করবে ? তুমি প্রভু দয়িত অতুল সামন্তকে  সেবা কর। তিনি অতি শীঘ্রই সেই চন্ডালিনীকে দূর করত নির্মল সাধু প্রেমকে তোমার হৃদয়ে সন্নিবেশ করবে।


২্। অপরাধঃ

       সাধু ও ঈশ্বরের প্রতি (পাপ, পাতক, মহাপাতকাদি) কৃত হলে তাহাদিগকে অপরাধ বলে। অপরাধ - সর্বাপেক্ষা কঠিন ও বর্জনীয়।

অপরাধ শব্দটি দুটি শব্দাংশে গঠিতঃ  অপ - যার অর্থ হচ্ছে বিরোধী, বিহীন, বিয়োগ, বর্জন, নিয়ে নেওয়া বা হরণ করা, ত্যাগ করা এবং রাধ - যার অর্থ হচ্ছে সফলতা, সমৃদ্ধি, আনন্দ দান, স্নেহ ও প্রীতির প্রবাহ। অপরাধ শব্দের অর্থ - অবজ্ঞা করা বা অসন্তোষ উৎপাদন করা। তাই শাস্ত্রে পাওয়া যায় -

                বহু জন্ম কৃষ্ণ ভজি প্রেম নাহি হয়।

                অপরাধ পুঞ্জ তার আছয়ে নিশ্চয় ॥

                অপরাধ শূন্য হয়ে লহ কৃষ্ণনাম ।

                তবে জীব কৃষ্ণ প্রেম লভে অবিরাম॥


   


কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.