শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা - শ্রীরাস রসিকেভ্য নমঃ
ভূমিকা ঃ-
অখিল রসামৃতসিন্ধু মুরলীধর লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের সর্ব লীলা মুকুটমনি শ্রীরাস লীলায় তাঁর রসঘন স্বরূপের পরম স্ফূর্তি প্রকটিত। পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ হলেন সমস্ত আনন্দের মূল উৎস। জীব মাত্রেই আনন্দ লাভের প্রয়াসী। শ্রুতি বলেছে- “রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি। এষ হ্যেবানন্দয়তি।” সকলের মূল স্বরূপ পরমব্রহ্ম রস স্বরূপ এবং সেই রস স্বরূপ পরম ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণকে গ্রহণ করলেই জীব যথার্থ আনন্দ পেতে পারে, তিনিও জীবকে আনন্দ দান করে থাকেন। এই আনন্দ প্রদানের জন্য লীলারসিক শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন লীলা বৈচিত্র প্রকাশ করেন। স্বরূপানন্দ রস প্রদান করে অপূর্ণ জীবের পূর্ণতা সম্পাদনই শ্রীকৃষ্ণের লীলা বৈচিত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং এটাই তাঁর নিজ স্বভাব সুলভ আনন্দ আস্বাদন স্ফূর্তি। সেই রসঘন মূর্তি মুরলীধর গোপীনাথ শ্রীকৃষ্ণের সর্বোচ্চ রসাস্বাদন লীলাই হলো শ্রীধাম বৃন্দাবনের রাসলীলা।
সর্ব লীলা মুকুটমনি শ্রীশ্রীরাসলীলায় সর্বোচ্চ মাধুর্য্য ভাবের পরিপূর্ণ বিলাস প্রকটিত। পরম মাধুর্য্যময় শ্রীকৃষ্ণ প্রেমই হলো ভক্তের পরম আস্বাদ্য। নবকিশোর নটবর লীলারসিক শ্রীকৃষ্ণ ব্রজগোপীদের নিয়ে সেই রসময়ী লীলার প্রকাশ করে প্রিয় ভক্তকে আনন্দ দান করেন এবং আনন্দ স্বরূপ হয়েও প্রেমস্বভাবা ভক্ত ব্রজগোপীদের সহজ প্রেমে স্বয়ং পরমানন্দ আস্বাদন করেন।
অফুরন্ত আনন্দ-রস স্বরূপা রাসলীলার পরম পবিত্র রস ধারায় জীবজগতকে অভিষিক্ত করার জন্য ব্রজেন্দ্র নন্দন শ্রীকৃষ্ণ শ্রীধাম বৃন্দাবনে পরম মাধুর্য্যময়ী এই রাসলীলার অভিনয় করেছেন।
রাস কি ?
রাস শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো - বিনোদ, রসসমূহ, লাস্য (নৃত্যগীত), নৃত্য বিশেষ লীলা, বহু নর্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষ, ভোজন-পানাদির আস্বাদন ও গান, নট কর্তৃক গৃহীত কন্ঠী নর্তকীগণের পরস্পরের হস্ত ধারন পূর্বক মন্ডলী নৃত্য - এভাবে বিভিন্ন প্রকার অর্থে রাস শব্দের প্রয়োগ দৃষ্ট হয়।
‘রস’ - শব্দের পরে তব্ধিতের ‘ষ্ণ’ প্রত্যয়যোগে ‘রাস’ শব্দনিস্পন্ন হয়। রাসঃ = রস+ষ্ণ। “তস্য সমূহ” - এই সূত্রানুসারে “রসানাং সমূহঃ” - অর্থাৎ যত রকমের রস আছে তাদের সমষ্টির নাম রাস।
রস কি বস্তু ? শ্রীকৃষ্ণ বিষয়া রতি বা প্রীতি যখন-
বিভাব - (যেমন নায়ক, নায়িকা)
অনুভাব - (নৃত্য-গীত-রোদনাদি)
সাত্ত্বিকভাব - (অশ্রু-কম্প-পুলকাদি) এবং ব্যাভিচারীভাব - (হর্ষ-বিষাদ-দৈন্যাদি) - এই চারটি সামগ্রীর সহিত মিলিত হয়, তখন অপূর্ব আস্বাদন-চমৎকারিত্বময় সুখে পরিণত হয়; তখনই তাকে রস বলে। শ্রীকৃষ্ণ বিষয়া রতি বা ভক্তি পরম বস্তু। ইহা যখন বিভাবাদি সামগ্রী চতুষ্টয়ের যোগে রসে পরিণত হয়, তখন তা পরম রস হয়। যে লীলাতে দ্বাদশ রসের উৎগারন হয় তাই রাস লীলা।
(ক) শ্রী বলদেব বিদ্যাভূষণ বলেছেন - “রসানাং সমূহো রাসঃ” -সমস্ত রস সমূহের সমষ্টিই রাস লীলা।
(খ) শ্রীল শ্রীধর স্বামী ভাবার্থ দীপিকায় বলেছেন - “রাসো নাম বহু নর্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষম্ ।” - বহু নর্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষকে রাস ক্রীড়া বলে।
(গ) শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর সারার্থ দর্শিনীতে বলেছেন - “নৃত্যগীত চুম্বনালিঙ্গনাদিনাং রসানাং সমূহো রাসস্তময়ী ক্রীড়া।” - যে লীলায় নৃত্য-গীত চুম্বনালিঙ্গনাদি রস সমূহ বিদ্যমান থাকে তাকে রাস লীলা বলে।
(ঘ) শ্রীল জীব গোস্বামী সংক্ষেপ বৈষ্ণব তোষনীতে বলেছেন-
“নর্টেগৃহীত কন্ঠী নামন্যোনাত্ত করশ্রিয়াম।
নর্তকীনাং ভবেদ্রাসো মন্ডলীভূয় নর্তনম্ ॥”
এক এক নট এক এক নর্তকীর কন্ঠ ধারণ করে এবং নর্তক-নর্তকী পরস্পরের হস্ত ধারণ পূর্বক ম-লী বন্ধনে যে নৃত্য কলা তাকে রাস লীলা বলে।
(ঙ) শ্রীল সনাতন গোস্বামীপাদ (বৃহৎ বৈষ্ণব তোষনীতে) বলেছেন- “রাসঃ পরমরসকদম্বময়ঃ ইতি।” - রাস হলো পরম রস সমূহের সমষ্টি।
রাস ক্রীড়াতে দ্বাদশটি পরম রস বা ভক্তিরস উৎসারিত হয়। দ্বাদশটি পরম রসের উৎসারণ ঘটাতে পারে একমাত্র মাদনাখ্য মহাভাব - যা হ্লাদিনীর সার ও নর্বোভাবদ্গমোল্লাসী একমাত্র রাধারানীতে এই ভাব বিরাজ করে, অন্য কোন গোপীতে নেই। উজ্জ্বল নীলমনি গ্রন্থে শ্রীল রূপ গোস্বামী স্থায়ীভাব প্রকরণে (১৫৫) বলেছেন -
“সর্বোভাবোদ্গমোল্লাসীমাদনোহয়ং পরাৎপরঃ।
রাজতে আহ্লাদিনী সারো রাধায়ামেব যঃ সদা ॥”
যে স্থলে রাধারানী, সেখানেই হ্লাদিনী সার মাদন, সেখানেই সমস্ত ভক্তিরসের উৎসারণ, সেখানেই রাসলীলা হতে পারে। এই জন্য রাধারানীকে রাসেশ্বরী বলা হয়।
জড় জগতের নর্তক-নর্তকীর নৃত্য বিশেষকে রাস বলা যায় না। এমনকি দ্বারকায় মহিষীগণের সহিত শ্রীকৃষ্ণের ক্রীড়াকে রাস বলা যায় না। কারণ - “রাস পরমরসঃ কদম্বময়ঃ।” পরম রস সমূহই রাস লীলার প্রাণবন্ত। এই প্রাণবস্ত পরম-রস ব্রজ ব্যতীত কোথাও নেই। বৈকুন্ঠের রস চিন্ময় কিন্তু তা পরম রস নয়। ব্রজে মাদনাখ্য মহাভাবময়ী রাধারানীর মধ্যে এবং তাঁর সখী-মঞ্জরীদের মধ্যে এই পরম রসকদম্ব বিরাজমান। এই পরম রসকদম্ব বৈকুন্ঠে বা দ্বারকার মহিষীগণের মধ্যে নেই। ব্রজ ব্যতীত স্বর্গ, বৈকুন্ঠ বা দ্বারকায় বা অন্য কোন ভগবৎ ধামেও শ্রীমতী রাধারানী নেই। তাই রাস লীলাও নেই।
রাসের শ্রেণী বিভাগঃ
রাস প্রধানতঃ দুই প্রকার - (ক) নিত্য রাস ও (খ) মহারাস। আদি পুরাণে নিত্য রাসের কথা আছে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণাদি গ্রন্থে মহারাসের কথা আছে। মহারাস দুই প্রকার- (১) শারদীয় রাস ও (২) বসন্ত রাস।
(১) শারদীয় রাস ঃ - ভাগবতাদি গ্রন্থে শারদীয় রাসের কথা আছে। আশ্বিন ও কার্তিক দুই মাস শরৎ কাল। এই দুই মাসের পূর্ণিমাকেই প্রাচীন মতে শরৎ কালীন পূর্ণিমা বলে। সে জন্য বৃন্দাবন ধামে আশ্বিন ও কার্তিক দুই মাসে পূর্ণিমাতেই রাসলীলা পর্বানুষ্ঠান হয়ে থাকে। বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে কার্তিকী পূণিমায় রাস পর্বানুষ্ঠান প্রচলন দেখা যায়।
(২) বসন্ত রাস ঃ- বৈষ্ণব কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” নামক গ্রন্থে বসন্ত রাসের কথা আছে। মহাপ্রভুর পরবর্তী বৈষ্ণব মহাজনদের পদাবলীতে বসন্ত রাসের পদ দেখা যায়। বসন্তের দুই মাস গোবর্ধনের নিকটে পরাসৌলিতে রাধাকৃষ্ণ সখীগণসহ বসন্ত রাসের অনুষ্ঠান করেন।
এই রাস ক্রীড়ায় নট বা নটীর কোন পক্ষেরই স্ব-সুখ বাসনার গন্ধ পর্যন্ত থাকে না। আলিঙ্গন-চুম্বনাদির কথা যা দৃষ্ট হয় তা প্রীতি প্রকাশের দ্বার মাত্র, কারও লক্ষ্য বস্তু নয়। কারও কোন বাসনা থাকেনা বলে শ্রীল শ্রীধর স্বামী “রাসলীলাকে” নিবৃত্তিপরা বলেছেন। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী পঞ্চ অধ্যায়কে শ্রীকৃষ্ণের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের তুল্য বলেছেন। শ্রীল সনাতন গোস্বামী রাসলীলাকে পঞ্চ প্রাণ বলেছেন।
ব্রজগোপীদের শ্রেণী বিভাগ ঃ
শ্রীকৃষ্ণ প্রেয়সী ব্রজ রমনীগণ প্রধানতঃ দ্বিবিধ (১) নিত্যসিদ্ধা ও (২) সাধনসিদ্ধা। ব্রজে ললিতা-বিশাখাদি এবং শ্রীমতী রাধারানী নিত্যনিদ্ধা আর শ্রুতিচরী, ঋষীচরী ও দেবকন্যা এরা সাধন সিদ্ধা।
(১) নিত্য প্রিয়া বা নিত্যসিদ্ধা ব্রজগোপীগণঃ- হ্লাদিনী প্রধানা শ্রীমতী রাধারানী এবং তাঁর ললিতা, বিশাখা সহচরীগণ শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ শক্তিবলে প্রায় কৃষ্ণেরই তুল্যা। নিত্য প্রিয়াগণের শত শত যুথ আছে এবং ঐ প্রধানা গোপীগণের এক এক যুথে শত শত গোপী আছে। সর্ব গোপী মধ্যে মাদনাখ্য মহাভাবযুক্তা শ্রীমতী রাধা রানীই হলেন সর্বশক্তি গরীয়সী।
(২) দেবকন্যা বা দেবী পূর্বাগণ ঃ- ভাগবতের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, দেবকন্যাগণ গোকুলে গোপকন্যারূপে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। একসময় শ্রীকৃষ্ণের অংশরূপে কোনও স্বরূপ স্বর্গাদিতে অবতরণ করেন, তখন তাঁর সেবার জন্য নিত্য কান্তা -গণের অংশ সকলও স্বর্গে দেবীরূপে আবির্ভূতা হন। তাঁরাই ব্রজে শ্রীকৃষ্ণ লীলায় গোপকন্যারূপে আবির্ভূত হয়ে নিত্য প্রিয় গণের প্রিয়সখী হয়েছেন।
(৩) মুনিচরী বা ঋষীচরী গোপীগণ ঃ- পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায় দন্ডকারণ্যবাসী মুনিগণ পূর্বে গোপাল উপাসক ছিলেন। ভগবান রামচন্দ্র বনবাসকালে দন্ডকারণ্যে আসলে মুনিগণ তাঁকে দেখে নিজ আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণ রূপে আরাধনার বাসনা হয়। তাঁরা লজ্জা বশত রামচন্দ্রকে প্রকাশ না করলেও ভক্ত বাঞ্ছাকল্পতরু শ্রীরামচন্দ্রের কৃপায় রাগভক্তি সাধনানুষ্ঠানে সিদ্ধি লাভ করে ব্রজে গোপী গর্ভে কন্যারূপে জন্ম গ্রহণ করে শ্রীকৃষ্ণের সেবাধিকার লাভ করেন।
(৪) শ্রুতিচরী গোপীগণ ঃ- বামন পুরাণ থেকে জানা যায় যে, ব্রহ্মলোক বাসিনী শ্রুতির অধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণ শ্রীকৃষ্ণের রূপ দর্শন করে গোপীদের ন্যায় সেবা করার প্রার্থনা জানায়। শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় তারা সাধনা করে ব্রজে গোপীদেহ লাভ করে কৃষ্ণ সেবাধিকার প্রাপ্ত হন।
সাধনসিদ্ধা গোপীগণের মধ্যে যাঁরা মহাভাব পর্যন্ত প্রেম পরিপাক লাভ করেছেন তাঁরা রাসলীলায় অংশ গ্রহণ করতে পেরেছেন। আর যারা প্রেম পরিপাক লাভ করতে পারেনি তারা পতিগণ কর্তৃক গৃহে অবরুদ্ধ হয়েছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই