শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা
শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনের ভূমিকা
মাধুর্য্য লীলার উৎকর্ষঃ
লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা অনাদি ও অনন্ত। অপার অনন্ত লীলার মধ্যে শ্রীধাম বৃন্দাবনে - দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর - এই চারি ভাবের লীলাই অধিক মাধুর্য্যপূর্ণ। চারি ভাবের লীলার মধ্যে আবার কান্তাভাবময়ী মধুর লীলার উৎকর্ষ সর্বাধিক। কান্তাভাবময়ী মধুর লীলা, যেমন - রাসলীলা, নৌকাবিহার, কুঞ্জবিহার, ঝুলন লীলা বা হিন্দোল লীলা, জলকেলি-মধুপানলীলা ইত্যাদি বিশেষভাবে পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণ লীলারস নিজে আস্বাদন করার জন্য এবং ভক্তদিগকে আনন্দ প্রদানের জন্য মাধুর্য্যময়ী লীলা বিগ্রহ ধারণ করেন। পদ্মপুরাণে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - “মদ্ভক্তানাং বিনোদার্থং করোমি বিবিধ ক্রিয়া”- আমার ভক্তদিগকে পরমানন্দ প্রদানের জন্য আমি বিবিধ লীলা করে থাকি।
শ্রবণে অনধিকারীঃ
এই রস কিন্তু এই লীলারস কৃষ্ণ বহিঃর্মুখ জীব আস্বাদন করতে পারে না। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বলেছেন-
আস্বাদ নাহি অভক্তের গণে।
কৃষ্ণ ভক্তগণ করে রস আস্বাদনে ॥
ভক্তই একমাত্র কৃষ্ণভক্তি রস আস্বাদন করতে পারে। আর অভক্ত কৃষ্ণ বহিঃর্মুখী জীব কৃষ্ণলীলা বুঝতে পারে না। কর্মী, জ্ঞানী, যোগী, ধ্যানী, ভোগী, সহজিয়া এরা শ্রীকৃষ্ণের পরম মধুর লীলারস আস্বাদন থেকে চির বঞ্চিত। কেননা তাদের চিত্ত নিরস ও রুক্ষভাব পূর্ণ। আর বিজাতীয় ভাবে শ্রীকৃষ্ণের মধূর লীলা বা অনন্ত লীলা রস আস্বাদন করা যায় না। রাসলীলা, ঝুলনলীলাদি দাস্য, বাৎসল্য ভক্তের উপাস্য নয়। কেননা রহস্য লীলা তাদের স্বীয়ভাব বিরুদ্ধ।
রাধাকৃষ্ণ লীলা অতি গুহ্যতর।
দাস্য-বাৎসল্যাদি ভাবের না হয় গোচর ॥
শ্রবণের যোগ্যতাঃ
যে সকল অচঞ্চল ধীর ভক্ত অটল শ্রদ্ধাপূর্ণ কোমল হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও ব্রজগোপীদের লীলা কথার মর্ম গ্রহণের জন্য আগ্রহান্বিত হন, তাঁরাই স্বজাতীয় স্নিগ্ধ ভক্তের শ্রীমুখ থেকে শ্রবণে প্রবৃত্ত হন। এই প্রকার ভাগ্যবান জনই শ্রীকৃষ্ণের মধুর লীলা কথার মর্ম গ্রহণে ও রস আস্বাদনে সমর্থ হন।
যেমন কোন সুরকার কোন কার্যোপলক্ষে পরিশ্রান্ত হলে তার বিশ্রাম কক্ষের অলিন্দ পথে দোলায় আরোহণ করে মৃদুমন্দভাবে দুলতে থাকে এবং তার সেবকগণ চামর ব্যজনাদি সেবা করে ও পানক তাম্বুলাদি প্রদান করে যে ভাবে আনন্দ লাভ করে, তদ্রপ বৃন্দাবন নায়ক শ্রীকৃষ্ণ গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়াবিহারাদিতে পরিশ্রান্ত হয়েছেন মনে করে শ্রীকৃষ্ণের লীলা শক্তির নির্দেশে বর্ষা ঋতু যেন শীতল বায়ু ও সুক্ষ্ম বৃষ্টিকণাদিসহ সেবক রূপে শ্রীবৃন্দাবনে এসে সপার্ষদ শ্রীকৃষ্ণের হিন্দোল বা ঝুলন লীলা সেবায় মগ্ন হলেন।
শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা বা হিন্দোল লীলা ঝুলনের সময়কালঃ
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের “ঝুলন যাত্রা বা হিন্দোল লীলা”- বৈষ্ণব সমাজে এক বিশেষ প্রচলিত আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। শ্রী ব্রজমন্ডলে শ্রাবণী শুক্লা তৃতীয়া হতে শ্রাবণী রাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই ঝুলন যাত্রা অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। গৌড় মন্ডলে শ্রাবণী শুক্লা একাদশী থেকে শ্রাবণী রাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই ঝুলন যাত্রা বা হিন্দোল লীলার অনুষ্ঠান হয়।
প্রামাণিক গ্রন্থঃ
গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্য শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর “গোবিন্দ লীলামৃত”, শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের “শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত” এবং শ্রীল কবিকর্ণপুর গোস্বামীর “আনন্দ বৃন্দাবন চম্পু”- এসকল বৈষ্ণব সংস্কৃত কাব্যে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের ঝুলন বা হিন্দোল লীলা সম্পর্কে মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে। বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে গোবিন্দ দাস, বৈষ্ণব দাস, জগন্নাথ দাস, উদ্ধব দাস, শিবরাম দাস, বাসুঘোষ, নন্দ দাস, কৃষ্ণানন্দ প্রমুখ পদকর্তাগণ ঝুলন যাত্রা বিষয়ক পদ রচনা করেছেন।
বিভিন্ন ঋতুতে লীলাশক্তির ক্রিয়াঃ
অখিল ব্রহ্মান্ড পতি নিত্য নব নব লীলা বিহারী শ্রীকৃষ্ণের যখন যেমন লীলার সঙ্কল্প হয়, তাঁর লীলাশক্তি তখনই সেইভাবে তাঁর লীলাক্ষেত্র ও লীলা পার্ষদগণকে বিভাবিত করেন। সুখময় বৃন্দাবন ভূমিতে যদিও নিত্য বসন্ত ঋতুর প্রকাশ থাকে, তথাপিও অন্যান্য ঋতুসকল শ্রীকৃষ্ণের সেবার সুযোগ গ্রহণ করে। তাই লীলা রসিক শ্রীকৃষ্ণের জলবিহার, বনবিহারাদি নানাবিধ গ্রীষ্মকালীন লীলার সেবা করে, লীলাভুমি বৃন্দাবন হতে গ্রীষ্ম ঋতু বিদায় গ্রহণ করলে, শ্রীকৃষ্ণের বর্ষা বিহারের সঙ্কল্প বুঝে তাঁর লীলাশক্তি বর্ষার আগমন ঘটিয়ে বৃন্দাবনের ভুমি, বৃক্ষ-লতা, পশু-পাখি ও ব্রজবাসীদের এমনভাবে ভাবিত ও সজ্জিত করেন যে, সকলেই কৃষ্ণের বর্ষা বিহারের আনন্দ উপেেভাগ করতে পারেন।
বর্ষা ঋতুতে বৃন্দাবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও পরিবেশঃ
গ্রীষ্মকালীন সূর্যতাপে বৃন্দাবনের তরুলতাদি শুষ্কপ্রায় ও পশুপাখি প্রায় ম্রিয়মান হয়। গ্রীষ্মের অবসানে বর্ষা ঋতুর আগমনে মেঘযুক্ত বর্ষার নব বারি সম্পাতে বনভূমির বৃক্ষরাজি নব পল্লব ধারণ করে অভিনব মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। বর্ষা ঋতুজাত যুথিকা, কদম্ব, কেতকী নানা পুষ্পাদি বৃন্দাবন ভুমিকে অলংকৃত করে, শিখিকুল পাখা বিস্তার করে পরম সুখে নৃত্য করে বিভিন্ন পাখির কল-কূজনে বনভূমি মুখরিত। গগন মন্ডল মেঘমালায় আবৃত থেকে মৃদু মৃদু গর্জন করে মন্দ মন্দ বারিধারা বর্ষন করছে। এমন মনোমুগ্ধকর শোভা দর্শন করে সখী বৃন্দাদেবী, কুন্দলতাদি সখীগণ শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে বর্ষা ঋতুর “প্রীতি উপহার” ঝুলন লীলা বা হিন্দোল লীলার অনুষ্ঠান করার জন্য উৎফুল্লিত হলেন।
হিন্দোল লীলার স্থানঃ
বর্ষনায় বৃষভানুপুরে শ্রাবণী শুক্লা তুতীয়া হতে পূর্ণিমা পর্যন্ত শ্রীরাধা নিত্যবৎ প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করে কুন্দলতা সঙ্গে নন্দালয়ে গমন করত রন্ধন-ভোজনাদি সমাপনান্তে নন্দীশ্বর গুপ্তকুন্ডের তীরে যোগপীঠ মিলন লীলা করে, আবার বর্ষনায় বৃষভানুপুরে ফিরে গিয়ে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করেন। তারপর সূর্যপূজার জন্য মিষ্টান্নাদি প্রস্তুত করত বেষ-ভূষায় সজ্জিত হয়ে সখীগণ সঙ্গে ঝুলা খেলার জন্য বর্ষনার বৃষভানু নন্দিনী নৈঋত কোনস্থ কদম্বখন্ডীতে গমন করেন।
কদম্বখন্ডীতে হিন্দোলের গঠন ঃ
কদম্ব খন্ডীতে বৃষভানু মহারাজ পূর্বেই মনোরম রত্নময় হিন্দোল তৈরী করে রেখেছিলেন। তার অষ্টদিকে সুবর্ণ রচিত ও রত্ন খচিত অতি উচ্চ অষ্ট স্তম্ভ, তাতে স্বর্ণ সূত্রে বদ্ধ অরুনবর্ণ বিচিত্র চন্দ্রাতপ। তার চারপার্শ্বে স্বর্ণ সূত্রে গ্রত্থিত মুক্তারঝালর এবং তার চারদিকে পত্রপুষ্প নির্মিত তোরন বন্ধন মালা, তাতে ভ্রমর সমূহ গুঞ্জন করছে। মধ্যস্থলে দু-জোড়া মনিময় স্তম্ভ। তাতে অষ্টদল পদ্মাকৃতি মনিময় হিন্দোলা জড়ি মোড়ান পট্টডোরীতে নাভী মাত্র উচ্চে ঝুলানো রয়েছে। ঐ হিন্দোলায় সুকোমল আসনাদি রয়েছে এবং তার উপরে বিচিত্র চন্দ্রাতপ মুক্তাগুচ্ছের ঝালরযুক্ত বন্ধন মালায় পরিশোভিত রয়েছে।
হিন্দোলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঃ
হিন্দোল মন্ডপের চারিদিকে বৃক্ষ শ্রেনীতে রত্ন নির্মিত অসংখ্য পাটীহিন্দোলা পরম শোভা বিস্তার করছে। আকাশে মেঘ সূর্য কিরণ আচ্ছাদন করত মন্দ মন্দ গর্জনের সাথে সাথে অতি সুক্ষ্ম বৃষ্টিকণা বর্ষন করছে। শিখিগণ পক্ষ বিস্তার করে কে-কা ধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত করে আনন্দে নৃত্য করছে। কোকিল সমূহ বৃক্ষ শাখায় কুহু কুহু রবে গান করছে। ভ্রমর সমূহ সুমধুর গুঞ্জন করছে। এ সকল শোভা দর্শন করে শ্রীমতি রাধারানী পরমানন্দে সখীগণ সহ কদম্বখন্ডীর মন্ডপস্থ বেদীতে এসে বসে শ্রীকৃষ্ণের নিমিত্ত উৎকন্ঠিত চিত্তে তাঁর আগমন-পথপানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অপেক্ষা করছেন।
শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠে গমন ঃ
( শ্রীকৃষ্ণ ও যশোদার গোচারণ সম্পর্কে সংলাপ, মধুমঙ্গলের উক্তি, শ্রীকৃষ্ণকে নৃসিংহ মন্ত্রে রক্ষা বিধান ও কৃষ্ণসখা সঙ্গে গোষ্ঠে গমন)।
প্রাতঃ ভোজনান্তে শ্রীকৃষ্ণ গোষ্ঠ বিহারের উপযোগী বেশভূষাদি পরিধান করেন। ললাটে তিলক, কুঙ্কুম ও গৈরিক ধাতু দ্বারা অঙ্গরাগ, মস্তকে শিখিপুচ্ছ যুক্ত চূড়া, অঙ্গুলীতে অঙ্গুরীয়, কর্ণে কুন্ডল, বক্ষস্থলে গুঞ্জাহার,রত্নমালা,বৈজয়ন্তীমালা ও কৌস্তভমনি, হস্তে কেয়ূর ও কঙ্কন, চরণে নুপুর, উদরের বামে তুন্দবন্দের মধ্যে শৃঙ্গ, দক্ষিন কক্ষে মুরলী, বাম করে পীতবর্ণ যষ্ঠি, দক্ষিন করে ক্রীড়া কমল ধারন করে সখাগণের সাথে বনে গমনের জন্য প্রস্তুত হলেন।
যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, হে বৎস ! গোপালন কার্যে সূনিপূন শত সহস্র দাস থাকতে, তুমি গোচারণে যাচ্ছ! একি তোমার দুরাগ্রহ ! সুকোমল চরণে তুমি কাকর কন্টকাকীর্ণ বনে কিরূপে বিচরণ করবে ? যদি একান্তই যাবে তবে ‘ছত্র ও পাদুকা ধারণ করে যাও’। পিতামাতাকে ব্যাকুল দেখে শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন - হে মাতঃ! হে পিতঃ ! আমরা গোপ জাতি, গো সেবাই আমাদের ধর্ম। আমাদের সেবা গো-সমূহ ছত্র বিহিন ও পাদুকা বিহিন। তদ্রপ গোপগণও যদি ছত্র-পাদুকা ত্যাগ করে গো-পালন করতে পারেন - তবেই গো-সেবা ধর্মটি সুনির্মল হয়। ধর্ম হতে আয়ু ও যশের বৃদ্ধি হয়। যিনি ধর্ম রক্ষা করেন, ধর্মও তাকে রক্ষা করেন। শ্রীনন্দ ও যশোমতী মাতা কৃষ্ণের ধর্ম বুদ্ধি দেখে ভাবলেন নারায়ণের কৃপায় আমার ছেলের ধর্ম বুদ্ধি হয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণ আরও বললেন- আমরা তৃণপূর্ণ ক্ষেত্রে ধেনু সমূহ ছেড়ে দিয়ে নিবিড় পল্লবযুক্ত বৃক্ষের শীতল ছায়ায় বিচরণ করি। ধেনুগণ দূরে গেলেও মধূর মুরলীর শব্দে একত্রিত করতে খুবই সহজ। মা! তুমি যে কাকর কন্টকাকীর্ণ বলে বন পথের নিন্দা করলে, সে পথ তুমি দেখনি। দেখলে তার প্রশংসা করতে। সে পথ চমরী মৃগের পুচ্ছদেশ দ্বারা পরিমার্জিত ও মন সুশীতল ছায়াযুক্ত ও পুষ্পের গন্ধে সুবাসিত। ঝরা ফুলের স্তুপে সুকোমল তুলিকার মতো সে পথ। ভ্রমরের ঝঙ্কার, কোকিলের কুহুতান, ময়ূরের নৃত্য-ইত্যাদি রমণীয় শোভা তোমার মনমন্দিরকে মন্দাভূত করে রেখেছে। রহস্য পটু মধুমঙ্গল বলছে - মা! বনসুখের এক কণাও তোমার গৃহে নেই। আম্র, কদলী, দাড়িম্ব প্রভৃতি সুপক্ক ফলগুলো বৃক্ষ থেকে পেরে তৎক্ষনাৎ ভোজন করি। সেই প্রকার সুগন্ধ ও আস্বাদ তোমার গৃহপক্ক ফলে কখনো পাওয়া যায় না। আমাদের সখা শ্রীকৃষ্ণ ফল, পুষ্প ইত্যাদি সংগ্রহ করার অভিলাষেই বনে গমন করে, সখার সেই প্রকার অভিলাষ তোমার গৃহে পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মাতা যশোমতী এই প্রকার আনন্দ অনুভুতির কথা শুনে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হলেন বটে কিন্তু অসুরের উৎপাত আশঙ্কায় ব্যকুল হয়ে কৃষ্ণ সখাগণকে বললেন - হে বলভদ্র ! সুভদ্র ! মন্ডলী ভদ্র, তোমরা কৃষ্ণকে রক্ষণাবেক্ষন করবে। হে বিজয়াদি বৎসগণ ! তোমরা ধনুক-খড়গ-তরবারি ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণকে সুরক্ষা করবে। অতপর শ্রীনৃসিং দেবের মন্ত্র দ্বারা রক্ষা বন্ধন করে দিলেন। শ্রীনৃসিংহদেব তোমায় রক্ষা করুন। আকাশ-বাতাস-অরণ্য তোমার শুভদায়ক হোক।
শ্রীকৃষ্ণ ধেনুপাল অগ্রে করে বন গমনের উপক্রম করলেন। দু’চার পা অগ্রসর হয়ে দেখেন- পিতামাতা অনুগমন করছেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন - মা ! এদিক আর আগমন করো না, সবে গিয়ে আমার জন্য রসালা প্রস্তুত কর। হে পিতা ! আমার কন্দুক ক্ষেপনী ভেঙ্গে গিয়েছে, ঘরে গিয়ে পাঁচ-ছয়টি কন্দুক ক্ষেপনী তৈরী করবেন। যশোদা বললেন - বৎস! তোমার জন্য বনে ভোজ্য-পেয়াদি পাঠাব, তুমি মধ্যাহ্নে ভোজন করে অপরাহ্নে শীঘ্র এসো। শ্রীকৃষ্ণ বললেন - মাতঃ ! যদি শুনতে পাই তোমরা ভোজনাদি করে গৃহে সুস্থ হয়ে অবস্থান করছ, তবেই তোমাদের প্রেরিত দ্রব্য ভোজন করে শীঘ্র ঘরে আসব। তোমরা ভোজন না করলে আমিও ভোজন করব না আর গৃহেও আসব না। অতপর শ্রীকৃষ্ণ পিতামাতাকে প্রণাম করে বনে গমন করলেন।
“ গোপবেশ ধরি কৃষ্ণ সঙ্গে সখাগণ।
ধেনুবৃন্দ আগে করি যায় বৃন্দাবন ॥
মাতাপিতা পদে কৃষ্ণ করি নমস্কার।
নেত্র কোনে প্রিয়াগণে করয়ে সৎকার ॥
যথাযোগ্য সবাকারে করিয়া সম্মান।
গৃহেতে পাঠাইয়া বনে যায় অভিরাম ॥
শ্রীকৃষ্ণের আগমন প্রস্তুতি ঃ
এদিকে শ্রীকৃষ্ণ সখা ও ধেনুগণকে বলদেবের কাছে সমর্পন করে বর্ষা ঋতুর বনশোভা দর্শনের ছলে (পূর্ব সংকেতানুসারে) বর্ষনার কদম্ব খন্ডীর হিন্দোলস্থলীতে আগমন করেন। শ্রীকৃষ্ণের আগমনে দুর হতেই নূপুর ধ্বনি শ্রবণ করে শ্রীমতী রাধারানী কুঞ্জ মধ্যে গিয়ে লুকালেন। শ্রীকৃষ্ণ এসে রাধা রানীকে না দেখে সখীগণকে প্রশ্ন করলেন - ‘'তোমাদের সখী রাধা কোথায় ?’ সখীগণ বললেন - আমরা জানি না। শ্রীকৃষ্ণ তখন উৎকন্ঠিত হলেন। কিন্তু সখী বৃন্দাদেবী শ্রীকৃষ্ণকে ইঙ্গিতে কুঞ্জটি দেখিয়ে দিলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে খুঁজে পেলেন এবং উভয়ে উত্তম বেশভূষায় সমন্বিত হয়ে বাহিরে এসে বেদীতে বসলেন। তারপর সকল সখীগণ সহ রাধাকৃষ্ণ মিষ্টান্নাদি সেবন করত তাম্বুল ভক্ষন করলেন।
প্রথমবার ঝুলন ঃ
অতপর রাধারানী ও কৃষ্ণনচন্দ্র হিন্দোলায় আরোহণ করলেন। তখন সখীবৃন্দা দেবী পুষ্পারতি করলেন। সখীগণ মল্লার রাগে উচ্চস্বরে গান করতে করতে হিন্দোলা সঞ্চালিত করতে লাগলেন। এভাবে কিছু সময় আন্দোলিত হওয়ার পর দোলার বেগ মন্দীভূত হলে রাধাকৃষ্ণের সেবার সামগ্রী নিয়ে হিন্দোলার চতুর্দিকে অষ্টদলে অষ্টসখী উপবেশন করলেন । বিশাখার সাথে ললিতা তাম্বুল বীটিকা, চিত্রার সাথে চম্পকলতার চামর,ব্যজন ইন্দুলেখার সাথে তুঙ্গবিদ্যা স্বর্ণ পাত্রে সুবাসিত জলপুর্ণ স্বর্ণ জলঝারি ,সুদেবীর সাথে রঙ্গদেবী পঙ্ক-চন্দনাদি গন্ধানুলেপনাদি নিয়ে হিন্দোলায় বসে তাস্বুলাদি দ্রব্য দ্বারা রাধাকৃষ্ণের সেবা করতে লাগলেন। চতুর্দিগস্থ সকল সখীই রাধাকৃষ্ণকে আপন আপন সম্মুখে দেখতে পেলেন। অতঃপর সখী বৃন্দা ও কুন্দলতা দুদিক থেকে হিন্দোলা আন্দোলিত করতে লাগলেন। অন্যান্য সখীগণ নানা যন্ত্র বাজিয়ে মল্লার রাগে ঝুলন লীলার পদ গাইতে লাগলেন।
দ্বিতীয়বার ঝুলন ঃ
ভ্রমরগণ রাধাকৃষ্ণের বদন সৌরভে আকৃষ্ট হয়ে ঝুলনের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমন করতে লাগলেন। এরূপ কিছু সময় রাধাকৃষ্ণ হিন্দোলায় আন্দোলিত হয়ে হিন্দোলার বেগ স্থির হলে রাধারানী নীচে নেমে ললিতা ও বিশাখাকে শ্রীকৃষ্ণের দু’পার্শ্বে বসিয়ে কিছু সময় হিন্দোল আন্দোলিত করলেন। এরূপ ভাবে দু’দুজন করে সমস্ত সখীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ হিন্দোলায় আন্দোলিত হয়ে সকলেই পরম আনন্দ লাভ করলেন। বৈষ্ণব কবি শেখর রায় গেয়েছেন -
কানন দেবতী বৃন্দা সখী তথি
রাইয়ের সরসী কূলে।
বিচিত্র ঝুলনা করিল রচনা
সুখদ বকুল মূলে ॥
ঝুলনা উপরি নাগর নাগরি
আসিয়া বসিলা রঙ্গে।
ঝুলায় ঝুলনা সকল ললনা
ভাবে গদ্গদ্ অঙ্গে ॥
ঝুলনা ঝমকে রাধিকা চমকে
তা দেখি মাধব ভোর।
হাসিয়া হাসিয়া বাহু পসারিয়া
ধনীরে করল কোর ॥
রসবতী লৈয়া কোরে আগোরিয়া
ঝুলয়ে রসিক রায়।
সহচরীগণ ঝুলায় দ্বিগুণ
সুম্বরে পঞ্চম গায় ॥
ঝুলনা ধরিয়া মধুর করিয়া
কহয়ে শেখর রায়।
দেবতা পূজিতে চলহ তুরিতে
দিবস বহিয়া যায় ॥
পাটী ঝুলনায় আহোরণ ঃ
তারপর সকলে নীচে নেমে চতুর্দিগস্থ পাটী ঝুলনা সমূহে উঠলেন। রাসলীলার ন্যায় শ্রীকৃষ্ণ বহু মূর্তি হয়ে পৃথক পৃথক ভাবে সমস্ত সখীগণ সহ পৃথক পৃথক ঝোলায় ঝুলতে লাগলেন। তন্মধ্যে কোন একপাটী ঝুলনায় শ্রীকৃষ্ণ রাধারানীকে নিয়ে অতিবেগে ঝুলতে লাগলেন। ঝুলনার বেগে পতন ভয়ে ভীতা হয়ে রাধারানী চক্ষু মুদিত করলেন। এতদ্দর্শনে কোন সখী ঝুলনার বেগ মন্দীভূত করার জন্য ঝুলনার পাটী ধারণ করে নীচে ঝুলতে লাগলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ ঝুলনার বেগ শান্ত করে নীচে নেমে সমস্ত সখীগণ সহ কদম্ব মন্ডপে রত্ন বেদীতে বসলেন। বৃন্দাদেবী সখী পানক, ফলমূল মিষ্টান্নাদি সমস্ত সখীগণ সহ রাধাকৃষ্ণকে সেবা করায়ে তাম্বুলাদি প্রদান করলেন। এভাবে সকলে আনন্দ সাগরে মগ্ন হলেন। এরপরে তারা মধুপান লীলা করলেন।
পতাকাযুক্ত হিন্দোলায় আরোহণ ঃ
বর্ষা ঋতুতে বনে পতাকাযুক্ত একখানি সুদৃশ্য হিন্দোলায় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানী পরস্পর পরস্পরের অভিমুখে (সামনাসামনি) উপবেশন করলেন। হিন্দোলার দুইদিকে দুই প্রাণসখী হিন্দোলা দোলাইতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে দোলনার বেগ শান্ত হলে কোন সখী রাধাকৃষ্ণের মুখে তাম্বুল বীটিকা প্রদান করলেন। মান্য সখীগণ রাধাকৃষ্ণের উপর পরাগ (পুষ্পরেনু) বৃষ্টি করলেন।
স্বর্গের দেবীগণের উক্তি ঃ
গগন মন্ডলে দেবীগণ রাধাকৃষ্ণের হিন্দোল লীলা দর্শন করে পরস্পরে বলতে লাগলেন, আমাদের কি সৌভাগ্যের উদয় হলো যে, আমরা গোপী জন্ম লাভ ব্যতীতই রাধা-মাধবের অপরূপ হিন্দোল লীলা দর্শন করছি। তাঁরা দিব্য সুগন্ধি কুসুম বর্ষন করতে লাগলেন। সেই সময় গগনস্থ মেঘ ও জলকণা বর্ষন করতে লাগল। এতে পুষ্পের সহিত বর্ষনরত জলকণা মিলিত হয়ে মকরন্ধত্ব প্রাপ্ত হলো। পরে শ্রীকৃষ্ণ রাধারানীর এবং গোপীদের অঙ্গে মুক্তাবৎ পতিত হয়ে মুক্তা ভূষণের (মুক্তার অলঙ্কারের) ন্যায় দৃষ্টি গোচর হলো।
অলিকুলের স্তুতি ঃ
ব্রজদেবীগণ যখন সুমধুর সঙ্গীত করছিলেন তখন তাঁদের শ্রীমুখের সৌরভ নিঃসৃত হওয়ায় অলিকুল মুখের কাছে গুঞ্জন করছিল, তা দেখে বোধ হলো যে, অলিকুল ব্রজগোপীদের শ্রীমুখের স্তুতি করছে।
পত্রপুষ্পের ব্যজন সেবা ঃ
যে তরুশাখা মূলে দোলা রজ্জু বাধা ছিল, তারাই দোলা বেগে চপল হয়ে শাখা অগ্রবর্তী কুসুম সম্বলিত পত্র শ্রেণী যেন সুগন্ধি ছড়িয়ে ব্যজন দ্বারা শ্রীরাধাকৃষ্ণের সেবা করছে।
অঙ্গ দর্পনে প্রতিবিম্ব দর্শন ঃ
হিন্দোলাপরি রাধাকৃষ্ণ পরস্পরের অভিমুখে বসে থাকায় দোলার বেগে সামনে পিছনে যাওয়ায় যখন রাধা দোলার উর্ধে থাকেন শ্রীকৃষ্ণ তখন নিম্নে থাকেন, আবার শ্রীকৃষ্ণ যখন উর্ধ্বে থাকেন রাধা তখন নিম্নে থাকেন। দোলার বেগ অতি দ্রত হওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণের মরকত মুকুর সদৃশ অঙ্গে রাধারানী শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে নিজ প্রতিবিম্ব দেখতে লাগলেন। এরূপ হেম দর্পন সদৃশ শ্রীরাধা তনুতে শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে দেখতে না পেয়ে নিজ প্রতিবিম্ব দেখতে লাগলেন। এজন্য উভয়ে দুঃখিত হলেন। তৎকালে উভয়ের দর্পন সদৃশ অঙ্গ মলিন হওয়ায় নিজ প্রতিবিম্ব এবার দেখতে না পেয়ে উভয়ে উভয়কে দর্শন করে পরমানন্দ লাভ করলেন।
শ্রীকৃষ্ণের বহু মূর্তি ঃ
অতপর রাধারানী দোলা হতে অবতরণ করে ললিতা-বিশাখা সমস্ত সখীগণ সহ শ্রীকৃষ্ণকে দোলায় আন্দোলিত করলেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণ পৃথক পৃথক ছোট ঝুলনায় একই সময়ে বহু মূর্তি ধারণ করে রাস লীলার ন্যায় দুই দুই সখীর মধ্যে অবস্থান করে ঝুলনায় আন্দোলিত হলেন। এতে সকলেই পরমানন্দ লাভ করলেন।
পদ্মদোলা ঃ
চতুর্বিংশতি দলযুক্ত পদ্ম পুষ্পের আকৃতি বিশিষ্ট এক কারুকার্য মন্ডিত অপূর্ব হিন্দোল আছে। সখী বৃন্দাদেবী শ্রীকৃষ্ণকে সেই দোলা দেখানো মাত্রই শ্রীকৃষ্ণ রাধারানী ও সখীগণের সহিত সেই পদ্মাকৃতি দোলায় উপবেশন করলেন। দোলামঞ্চে বৃন্তহীন পুষ্পের উপরি দিব্য বস্ত্র আভরণ ও পুষ্পের উপাধান আছে। শ্রীকৃষ্ণ পুষ্প দোলার কণিকা স্থলে রাধারানীকে নিয়ে উপবেশন করলেন এবং অষ্টদলে অষ্ট প্রধানা সখীগণ ললিতা-বিশাখা-চিত্রা-চম্পকলতা-ইন্দুলেখা-তুঙ্গবিদ্যা-রঙ্গদেবী ও সুদেবী উপবেশন করলেন। তার বাহিরে ষোড়শ উপদলে ষোড়শ সখী বসলেন। এদিকে বৃন্দাদেবী পুষ্প দোলায় উপবেশন রত রাধাকৃষ্ণকে সুমিষ্ট পানক ও রসাল ফল প্রদান করলেন। রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণ পানক পান করে ও সুমিষ্ট ফলের কিয়দংশ ভোজন করে বাকী অংশ সখী বৃন্দাকে প্রদান করলেন। তারা তা আনন্দে ভোজন করলেন। ভেজনান্তে স্বর্ণকান্তি তাম্বুল বীটিকা সেবন করলেন
চব্বিশ দলযুক্ত দোলা সঞ্চালন ঃ
অতপর সখী বৃন্দাদেবী ও নান্দীমুখী হিন্দোলার দুদিক থেকে পরমানন্দে হিন্দোল আন্দোলিত করতে লাগলেন। তদ্দর্শনে উপস্থিত সখীবৃন্দ উল্লাস চিত্তে ও পরমানন্দে বিভিন্ন প্রকার রাগ-রাগরাগিনীতে সুমধুর স্বরে সঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগলেন। শ্রীকৃষ্ণ উৎফুল্লিত হয়ে হিন্দোল লীলা ও সখীবৃন্দকে বার বার জয়ধ্বনি দ্বারা জয় দিতে লাগলেন। এইভাবে সখীগণ সহ রাধাকৃষ্ণ হিন্দোল লীলার সুখলাভ করেন। পরে দোলনার বেগ শান্ত হলে দোলা হতে অবতরণ করে কাননে ভ্রমন করেন।
বৈষ্ণব পদাবলীতে বৈষ্ণব দাস গেয়েছেন-
ঝুলনা হইতে নামিয়া তুরিতে
রসবতী রস-রাজ।
রতন-আসনে বসিয়া যতনে
রতন মন্দির মাঝ ॥
সুচামর লেই বীজন বীজই
সেবা-পরায়ণা সখী।
সুবাসিত জলে বদন পাখালে
বসনে মোছাঞা দেখি ॥
থারি ভরি কোই বিবিধ মিঠাই
ধরি দুহু’ সম্মুখে।
সখীগণ সহে কতহ’ কৌতুকে
ভোজন করিল সুখে ॥
তাম্বুল সাজাঞা কোন সখী লৈয়া
দোহার বদনে দিল।
এ কেশ-কুসুমে আপাদবদনে
নিছিয়া নিছিয়া নিল ॥
সূর্য্যপূজা ঃ
অতপর মুখরাকে আগমন করতে দেখে বৃন্দাদেবী রাধারানীকে রাধাকুন্ডে মিলন সঙ্কেত জানিয়ে শ্রীকৃষ্ণ সহ প্রস্থান করলেন। মুখরা এসে বললেন- কি আশ্চর্য ! এখনো তোমরা এখানে বসে আছ ? বেলা অধিক হলো। শীঘ্র সূর্য্যকুন্ডে গিয়ে পুষ্পাদি চয়ন করত সূর্যপূজা করে এস - একথা শুনে রাধারানী-সখীগণ সহ সূর্য্যপূজার উপকরণাদি লয়ে সূর্য্যকুন্ডে গমন করলেন। এইভাবে হিন্দোল লীলা শ্রাবনী পূর্ণিমা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।
নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ঝুলন লীলা ঃ
নবদ্বীপে শ্রাবনী শুক্লা তৃতীয়া দিবসে শ্রীমন্মহাপ্রভু ভক্তবৃন্দ সহ নিত্যলীলাক্রমে পূর্বাহ্নে বন-ভ্রমনে বহির্গত হন। যুথি, কদম্ব, কেতকী ইত্যাদি কুসুম সৌরভে প্রমত্ত ভৃঙ্গকুল গুঞ্জন করছে। মন্দ মন্দ বৃষ্টিধারা পতন হচ্ছে। বিভিন্ন পাখীর কূজনে বন ভূমি মুখরিত। এরূপ শোভা দর্শনে প্রভু ভক্তগণ সহ শ্রীবাসের পুষ্পোদ্যানে হিন্দোল মন্ডপে গিয়ে বেদীতে বসলেন। শ্রীবাস পন্ডিত পূর্বেই মনোরম হিন্দোলা প্রস্তুত করে সুসজ্জিত করে রেখেছিলেন। হিন্দোলার অপূর্ব শোভা দর্শনে মহাপ্রভুর ব্রজভাব উদ্দীপন হল। মহাপ্রভুর মন জেনে স্বরূপ প্রভু শ্রীরাধাকৃষ্ণের ঝুলন লীলার পদ গাইতে লাগলেন। শ্রবণে মহাপ্রভু ভাবাবেশে শ্রীগদাধরকে বামে নিয়ে হিন্দোলায় উঠলেন। গদাধর মহাপ্রভুকে তাম্বুল প্রদান করে ব্যজনাদি করতে লাগলেন। শ্রীবাসাদি ভক্তবৃন্দ স্বরূপের সহিত মল্লার রাগে ঝুলন লীলার পদ গাইতে লাগলেন এবং ব্রজভাবে আবিষ্ট হলেন। ভক্তগণও ব্রজভাবে বিভাবিত হয়ে হিন্দোলা আন্দোলিত করতে লাগলেন। সকলেই ব্রজলীলা রসে মুগ্ধ হলেন।
বৈষ্ণব পদাবলী
(তথারাগ)
দেখত ঝুলত গৌরচন্দ্র
অপরূপ দ্বিজমণিয়া।
বিধির অবধি রূপ নিরুপম
কষিল কাঞ্চন জিনিয়া ॥
ঝুলায়ত কত ভকতবৃন্দ
গৌরচন্দ্র বেঢ়িয়া।
আনন্দে সঘন জয় জয় রব
উথলে নগর নদীয়া ॥
সয়ন কমল মুখ নিরমল
শরদ চাঁদ জিনিয়া।
নগরের লোক ধায় একমুখে
হরি হরি ধ্বনি শুনিয়া ॥
ধন্য কলিযুগ গোরা অবতার
সুরধুনী-ধনি-ধনিয়া।
গোরাচাঁদ বিনে আন নাহি মনে
বাসুঘোষে কহে জানিয়া ॥
(ধানশী)
ঝুলত গোরাচাঁদ সুন্দর রঙ্গিয়া।
প্রেম ভরে হৈয়া ডগমগিয়া।
রাধার ভাবেতে ধারা বয়ানেতে ভাসে।
ভাববুঝি গদাধর ঝুলে বাম পাশে ॥
মুরলী বলিয়া চাহে বদন হেরিয়া।
বাসুঘোষ গায় গোরাগুণ সোঙরিয়া ॥
রাখী বন্ধন ঃ
পূর্ণিমার দিনে বর্ষনায় বৃষভানুপুরে শ্রীমতি রাধারানী প্রাতঃকালে স্নানাদি সেরে বেশভূষায় সজ্জিত হলে গর্গ কন্যা গার্গী এসে শ্রীমতির রাধারানীর বাম হাতের মনিবন্ধে রাখী বন্ধন করেন এবং অন্যান্য সখীগণের হাতেও রাখী বন্ধন করেন। শ্রীমতি রাধারানী তাকে বস্ত্র অলঙ্কারাদি দান করে মিষ্টান্নাদি ভোজন করায়ে পূজা করেন। তখন নন্দালয় হতে আগতা হিরণ্যাঙ্গী সখীর মুখে শুনলেন যে, “ভাগুরি ঋষি শ্রীকৃষ্ণের হাতে রাখী বন্ধন করছেন”। তখন শ্রীমতি রাধারানী জলযোগ করত নিত্যবৎ নন্দালয়ে রন্ধনের নিমিত্ত গমন করেন। তথায় ভাগুরি ঋষির পত্নী শ্রীমতি রাধারানীর হাতে রাখী বন্ধন করেন। এভাবে শ্রাবনী পূর্ণিমায় বিপদ হতে রক্ষা কামনায় প্রিয়জনের মনিবন্ধে মঙ্গল সূত্র বেঁধে, রক্ষী বন্ধন বা রাখী বন্ধন করে রাখী বন্ধন লীলা সম্পন্ন হয়।
* * *
কোন মন্তব্য নেই