একাদশী ব্রত পালনে অসমর্থের ভোজন বিধি
ভগবান শ্রীহরির অঙ্গ হতে একাদশী দেবী আবির্ভূতা হয়ে মুরাসুরকে বধ করলে শ্রীহরি তাঁকে
বর দিতে ইচ্ছা করলে দেবী বললেন - হে দেব ! আপনি যদি আমাকে বর দান করেন, তবে এই বর দিন- আমার আবির্ভাব দিনে উপবাস পরায়ণ ব্যক্তিকে মহাপাপ হতে যেন উদ্ধার করতে পারি। উপবাসে যে ফল লাভ হয়, ফল-মূলাদি নক্ত ভোজনে তার অর্দ্ধফল, একভূক্ত ভোজনে তদপেক্ষাও অর্দ্ধফল- “উপাবাসস্য যৎ পুণ্যং তস্যার্দ্ধং নক্তভোজনে।
তদর্দ্ধঞ্চ ভবেত্তস্য একভুক্তং করোতি যঃ ॥”
জিতেন্দ্রিয় হয়ে ব্রতানুষ্ঠানকারী যেন উক্ত ফল প্রাপ্ত হয় - এই আমার প্রার্থনীয় বর। শ্রীভগবান বললেন - যে আমার ভক্ত সে তোমারও ভক্ত। আমি তোমার ব্রতকারীর সমস্ত পাপ নষ্ট করে পরম গতি দান করব।
মার্কন্ডেয় মুনি বলেছেন- নিরম্বু উপবাসে অসমর্থ হলে অনুকল্প গ্রহণ করে একাদশী ব্রতের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। যথা-
“একভুক্তেন নক্তেন বালবৃদ্ধাতুরঃ ক্ষিপেৎ।
পয়োমূল ফলৈর্ব্বাপি ন নির্দ্বাদশিকো ভবেৎ ॥” (মার্কন্ডেয় পুরাণ)
অর্থাৎ বালক, বৃদ্ধ বা পীড়িত ব্যক্তি জল, ফল-মূল দ্বারা একভুক্ত বা নক্তব্রত করে উপবাসের কাল অতিবাহিত করবেন, দ্বাদশীকে বৃথা যেতে দেওয়া উচিৎ নয়।
মহাভারতে উদ্যমপর্বে বলা হয়েছে-
“অষ্টৈতান্যব্রতঘœানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ।
হবির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম্ ॥”
অর্থাৎ জল, ফল, মূল, দুগ্ধ, ঘৃত ও ব্রাহ্মণ প্রার্থনা, গুরুবাক্য ও ঔষধ - এই আটটি ব্রত হানিকর নয়। অতএব উপবাসে অসমর্থ ব্যক্তি এই সমস্ত একবার মাত্র গ্রহণ পূর্বক একাদশী ব্রত পালন করতে পারেন।
গর্গসংহিতায় শ্রীকৃষ্ণ পৌত্র বজ্রনাভ একাদশী সম্বন্ধে গর্গাচার্যের কাছে জানতে চাইলে শ্রীগর্গাচার্য বললেন- একাদশীতে অন্ন এমন কি ফলও ভোজন করবে না, যথাবিধানে একাদশী করবে। বজ্রনাভ বললেন - যারা একাদশীতে ফলাহার করে তাদের কি গতি হবে ? ঋষি বললেন - যথাবিধি নিরম্বু উপবাসে যে ফল লাভ হয়ে থাকে, কেবল জলপানে তার কিঞ্চিৎ কম এবং ফলাহারে অর্দ্ধফল হয়ে থাকে। গোধূমাদি সর্ববিধ অন্ন বর্জন করে মানব একাদশীতে ফল ভোজন করতে পারে। যথা -
“অন্নান্ সর্ব্বান্ বর্জ্জয়িত্বা গোধূমাদ্যান্নৃপেশ্বর।
একাদশ্যাং প্রকুর্ব্বীত ফলাহারং মুদা নরঃ ॥” অশ্বমেধ খন্ড-৬১
[ গোধূমাদি বলতে সাত প্রকার ধান্যের অন্নের কথা নির্দেশ করে। যথা - শ্রীসনাতন গোস্বামীর টীকায় - “ যব-গোধূম-ধান্য-তিল-কঙ্গু-শ্যামাকনীবারাত্মক - সপ্তধান্যানি ॥
(হরিভক্তি বিলাস- ২০।১৯৬)
অর্থাৎ যব, গম, ধান্য (শালিধান্য), তিল, কাঙন, শ্যামা, নিবার(আশু ধান্য)]
রাজা বজ্রনাভকে গর্গঋষি ফল-মূলাদি ভোজন সম্পর্কে বললেন -
“দধি দুগ্ধং তথা মিষ্টং কূটং কর্কটিকাং তথা।
বাস্তুকং পদ্মমূলঞ্চ রসালং জানকীফলম্ ॥
গঙ্গাফলং পত্রনিম্বুং দাড়িম্বঞ্চ বিশেষতঃ।
শৃঙ্গাটকং নাগরঙ্গং সৈন্ধবং কদলীফলম্ ॥
আ¤্রাতকং চার্দ্রকঞ্চ তূলঞ্চ বদরীফলম্।
জম্বুফলমামলকং পটোলং ত্রিকুশং তথা ॥
রতালুং শর্করাকন্দমিক্ষুদন্ডং তথৈব চ।
দ্রক্ষাদীনি হি চান্যানি পবিত্রঞ্চ ফলং তথা ॥
একবারঞ্চ রাজেন্দ্র ভোক্তব্যং হরিবারে।”(গর্গসংহিতা, অশ্বমেধ খন্ড-৬১ অ.)
অনুবাদ- একাদশীতে উপবাসে অসমর্থের পক্ষে দধি, দুগ্ধ, মিষ্ট(ওদন ও ব্রীহি ব্যতীত চিনির ন্যায় স্বাদযুক্ত দ্রব্য), কূট, কর্কটিকা (কাঁকুড় বা শশা), বাস্তুক(বেথুয়া শাক), পদ্মমূল(শালুক), আ¤্র, জানকীফল, গঙ্গাফল, পত্রনিম্বু, দাড়িম(বেদানা), শৃঙ্গাটক(পানিফল), নাগরঙ্গ(কমলালেবু), সৈন্ধব(সৈন্ধব লবন), কদলী(কলা), আ¤্রাতক(আমড়া), আর্দ্রক( আদা), তূল, বদরী(কুল), জম্বু(জাম ), আমলক(আমলকী ফল) পটোল(সব্জীজাতিয় ফল), ত্রিকুশ, রতালু, শর্করাকন্দ(মিষ্টি আলু), ইক্ষুদন্ড, দ্রাক্ষাদি(আঙ্গুরাদি) এবং অন্যান্য পবিত্র ফল-মূল একবার মাত্র চতুর্থ প্রহরে ভোজন করতে পারা যায়। কেবল জলপান কল্পে বারদ্বয় জলপান কর্তব্য। একবার মাত্রই ফলমূলাদি ভোজন কর্তব্য। দু’তিনবার ভোজনে কিছুমাত্র ফললাভ হয় না।
একাদশী সম্পর্কে বিশেষ বিধি সম্বন্ধে শ্রীভগবানের উক্তি রয়েছে। যথা - কাশ্যপ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে-
“মদুত্থানে মচ্ছয়নে মৎপার্শ্ব পরিবর্তনে।
অত্র যো দীক্ষিতঃ কশ্চিৎ বৈষ্ণবো ভক্তিতৎপরঃ ॥
অন্ন বা যদি ভুঞ্জীত ফলমূলমথাপি বা।
অপরাধমহং তস্য ন ক্ষমামি কদাচন।
ক্ষিপামি নরকে ঘোরে যাবদাহুতসংপ্লবম্ ॥” (কাশ্যপ পঞ্চরাত্র)
অনুবাদ - শ্রীভগবান বললেন- আমার উত্থান একাদশী, পার্শ্বপরিবর্তন একাদশী এবং শয়ন একাদশীতে যে কোন দীক্ষিত কৃষ্ণভক্তিপরায়ণ বৈষ্ণব যদি অন্ন বা ফল-মূল ভক্ষন করে, তার পূর্বকৃত ও অধুনাকৃত কোন অপরাধ ক্ষমা করি না, প্রলয়কাল পর্যন্ত ঘোর নরকে নিপাতিত করে রাখি।
অন্যত্র আরো বলা হয়েছে যে-
“মচ্ছয়নে মদুত্থানে মৎপার্শ্ব পরিবর্তনে।
ফল-মূল-জলাহারী হৃদি শল্যং মমার্পয়েৎ ॥”
অনুবাদ - শ্রীভগবান বললেন - আমার শয়ন, পাশ্বপরিবর্তন ও উত্থান একাদশীতে ফল-মূল-জল গ্রহণকারী ব্যক্তি আমার হৃদয়ে শল্য (তীর) বিদ্ধ করে। অর্থাৎ মহা অপরাধী হয়।
মাতা যেমন শিশুকে রক্ষা করে, ঔষধ যেমন রোগ সমূহ নিবারণ করে তেমনি সর্বলোকের রক্ষার নিমিত্ত একাদশী তিথি ব্রত শ্রীভগবৎ কর্তৃক আবির্ভূত হয়েছেন। নানাবিধ দুঃখ পরিব্যাপ্ত এই সংসারে মানবজন্ম লাভ করে যিনি একাদশী ব্রত পালনে তৎপর তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই ধন্য। শ্রীভগবান মানুষের মহারোগ নিরাময়ের জন্য এবং দুঃখ শান্তির জন্য একাদশী ব্রতের সৃষ্টি করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই