অনর্থ নিবৃত্তির উপায়
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণে ভক্তিযোগই অনর্থ উপশমের কারন। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৭/৪-৬) বলা হয়েছে -
ভক্তিযোগেন মনসি সম্যক্ প্রানিহিতেহমলে।
অপশ্যৎ পুরুষং পূর্ণং মায়াঞ্চ তদপাশ্রয়াম্ ॥
যয়া সম্মোহিতো জীব আত্মানং ত্রিগুণাত্মকম্।
পরোহপি মনুতেহনর্থং তৎকৃতঞ্চাভিপদ্যতে॥
অনর্থোপশমং সাক্ষাদ্ভক্তিযোগমধোক্ষজে ॥
শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদ-ব্যাসের নির্মল চিত্ত ভক্তিযোগের দ্বারা সমাধিস্ত হলে তিনি পূর্ণ পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শন পেলেন। কৃষ্ণের দূর-আশ্রিত মায়া তত্ত্বকে দর্শন করলেন। পরিপূর্ণ কৃষ্ণ স্বরূপে যে চিৎ শক্তি নিত্য অবন্থিত, তাঁর ছায়া স্বরূপ দূরস্থিত মায়াকে দেখলেন। চিৎ শক্তির অনুপ্রকাশরূপ জীবশক্তি প্রসূত চিৎকণ স্বরূপ মায়াপেক্ষা পরতত্ত্ব জীবকে দেখলেন। সেই জীব মায়া কর্তৃক মোহিত হয়ে আপনাকে মায়ার ত্রিগুণাত্মক তত্ত্ব বলে মনে করছেন। মায়াকৃত কার্য সকল অভিমান দ্বারা “আমার কৃত” বলে মনে করছেন। আরও দেখলেন যে অধোক্ষজ কৃষ্ণে ভক্তিযোগই সেই জীবের অনর্থ উশমের একমাত্র কারণ।
কৃষ্ণ, কৃষ্ণমায়া, জীব এই তিন তত্ত্ব।
মায়ামোহে মায়াবদ্ধ জীবের অনর্থ ॥
চিৎকণ জীবের কৃষ্ণভক্তিযোগ বলে।
অনর্থ বিনষ্ট হয় কৃষ্ণপ্রেমফলে ॥
এই তব নাম সমাধিতে পাইল ব্যাস।
ভাগবতে ভক্তিযোগ করিল প্রকাশ ॥
নাম সংকীর্তনে সকল অনর্থ দূর হয় -
আপন্ন সংসৃতি ঘোরাং যন্নাম বিবশো গৃণন্ ।
ততঃ সদ্যো বিমুচ্যেত যদ্বিভেতি স্বয়ং ভয়ম্॥
যাঁকে স্বয়ং ভয়ও ভয় করে, তাঁর ঘোর সংসৃতিতে বিপন্ন হয়ে বিবশতার সহিত যিনি উচ্চারণ করেন, তিনি সদ্য বিমুক্ত হন।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১/১/১৪) বলা হয়েছে-
ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যা-
দীশাদপেতস্য বিপর্যয়োহস্মৃদিঃ।
তন্মায়য়াহতো বুধ আভজেত্তং
ভক্তৈকয়েশং গুরুদেবতাত্মা ॥
পরমেশ্বর ভগবান হতে চ্যূত হয়ে জীবের স্মৃতি বিপর্যয় ঘটেছে। চ্যূত হয়ে মায়াগুণ রূপ দ্বিতীয় বিষয়ে অভিনিবেশ বশতঃ দেহাত্মাভিমান জনিত ভয় হয়েছে। জীব মায়াবদ্ধ। অতএব শ্রীগুরু চরণাশ্রয় পূর্বক পন্ডিত ব্যক্তি অনন্য ভক্তিসহকারে সেই শ্রীকৃষ্ণকে ভজন করলে মায়াকে অতিক্রম করতে পারেন।
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর মাধূয্য-কাদম্বনিী গ্রন্থে চার প্রকার অনর্থের মধ্যে প্রতিটি অনর্থ নিবৃত্তির পাঁচটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল-
(১) একদেশবর্তিনী - যখন অনর্থ অল্প অংশ বা কীয়ৎ পরিমাণে নাশ হয়ে থাকে (৫ শতাংশ - ১০ শতাংশ)।
(২) বহুদেশবর্তিনী - যখন অনর্থ বহুলাংশে নাশ হয়ে থাকে (৭৫ শতাংশ)।
(৩) প্রায়িকী - যখন অনর্থ প্রায় সব নাশ হয়ে থাকে (৯৫ শতাংশ)। অতি অল্প অবশিষ্ট থাকে।
(৪) পূর্ণ অনর্থ নিবৃত্তি - অনর্থের সম্পূর্ণ নাশ অর্থাৎ কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। একশ শতাংশই নিবৃত্তি। এই স্তরে সম্পূর্ণরূপে অনর্থের নাশ হয়ে থাকে সত্য, কিন্তু পূণরায় অনর্থের উদ্গম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(৫)আত্যন্ত্যিকী অনর্থ নিবৃত্তি - যখন সম্পূর্ণরূপে অনর্থ নিবৃত্তি হয়ে যায় এবং পুণর্বার উদ্গম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তখন তাকে আত্যন্ত্যিক অনর্র্থ নিবৃত্তি বলা হয়।
অপরাধোত্থ অনর্থ নিবৃত্তিঃ
গ্রামোদগ্ধ পটভগ্ন - গ্রাম দগ্ধ হয়েছে, পট ভগ্ন হয়েছে। এই ন্যায় অনুসারে ভজন ক্রিয়ার প্রারম্ভ থেকে কীয়ৎ পরিমাণে বা স্বল্পাংশে অনর্থ নিবৃত্তি হয়ে তাকে। যখন ভক্তি অনুশীলন নিষ্ঠার স্তরে পৌঁছায় তখন অনর্থের বহুদেশ বর্তিনী নিবৃত্তি হয়। রতি বা ভাবের আবির্ভাবে অনর্থের প্রায়িকী নিবৃত্তি হয়। প্রেমের উদয় হলে অনর্থের পূর্ণ নিবৃত্তি হয়। ভগবানের সাক্ষাৎ সঙ্গ লাভের ফলে আত্যন্তিক অনর্থ নিবৃত্তি হয়ে থাকে। অর্থাৎ অনর্থের পুনরোদ্গমের আর কোন সম্ভাবনা থাকে না। তা সত্বেও নিম্নলিখিত কয়েকটি ঘটনাবলী থেকে কেউ মনে করতে পারে যে, শ্রীভগবানের চরণকমল প্রাপ্ত হওয়ার পরেও অনর্থের পুনরোদ্গমের সম্ভাবনা থাকে ; কিন্তু এই প্রকার ধারনা মন থেকে বুদ্ধির দ্বারা দূর করা উচিত।
চিত্রকেতু ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম লাভ করেছিলেন। শিবের প্রতি তার তৎকারীক্ মহা অপরাধ প্রাতীতিক মাত্র। এটি বাস্তব নয়। যেহেতু তার এই ত্রুটি থেকে কোন খারাপ ফল দেখা যায় না। ভগবানের পার্ষদরূপে এবং বৃত্রাসুর রূপে উভয় ক্ষেত্রেই চিত্রকেতুর মধ্যে ভগবৎ প্রেম সম্পদ বিদ্যমান ছিল।
জয় ও বিজয়ের প্রাতীতিক অপরাধ প্রেমের দ্বারা উদ্দীপীত বা প্ররোচিত হয়ে স্বেচ্ছায় হয়েছিল। তারা দুজন এভাবেই ইচ্ছা করেছিলেন,“হে প্রভু ! হে দেবাদিদেব নারায়ণ ! আপনি যুদ্ধ করার আনন্দ উপভোগ করতে ইচ্ছা করেছেন। কিন্তু আমরা ব্যতিরেকে অন্য সবাই আপনাকে প্রতিরোধ করার জন্য অত্যন্ত দুর্বল। অন্যত্রও বলবান কাউকে দেখছি না। যদিও আমরা বলবান, আমরা আপনার প্রতিকুল নই। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে আপনার প্রতি শত্রুভাব নেই। অতএব কোন ভাবে আমাদেরকে আপনার বিরোধী ভাবাপন্ন করিয়ে আপনি যুদ্ধ রসের আনন্দ উপভোগ করুন। আপনার স্বতঃ পূর্ণতা বিন্দুমাত্র কম হোক, তা আমরা সহ্য করতে পারি না। অতএব আপনার ভক্ত বাৎসল্যতাকে লঘু করেও আপনার কঙ্কর আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ করুন।
দু®কৃতোত্থ অনর্থ নিবৃত্তিঃ
দু®কৃতোত্থ অনর্থ সমূহের ভজন ক্রিয়ার পর প্রায়িকী নিবৃত্তি হয়। নিষ্ঠার উৎপত্তি হলে পূর্ণ নিবৃত্তি হয়। আসক্তির উদয় হলে আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়।
ভক্তুত্থ অনর্থ নিবৃত্তিঃ
ভক্তি থেকে জাত অনর্থ সমূহের ভজন ক্রিয়ার পর একদেশবর্তিনী নিবৃত্তি হয়। নিষ্ঠার উৎপত্তি হলে পূর্ণ নিবৃত্তি ও রুচি জাত হলে আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়ে থাকে। বিষয় বস্তুর উপর সম্পূর্ণ বিচার করার পর অনুভবী মহৎ ব্যক্তিগণ এরূপ স্থির করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই