ভক্তই ভগবানকে জানেন
(১৯৯০ সালের ১৩ ই আগষ্ট, জন্মাষ্টমী তিথিতে বাংলাদেশে শ্রীল জয়পতাকা স্বামী মহারাজের ভাষণ)
এবং জন্মানি কর্মানি হ্যকর্তুরজনস্য চ।
বর্ণয়ান্তি স্ম কবয়ো বেদগুহ্যানি হৃৎপতে ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৩/৩৫)
এইভাবে বিদ্বানেরা সেই অজন্মা এবং অকর্মা ভগবানের জন্ম এবং কর্মের বর্ণনা করেন, যা বৈদিক শাস্ত্রেও অনাবিস্কৃত। তিনি হচ্ছেন হৃদয়েশ্বর।
শ্রীল প্রভুপাদ এই শ্লোকের তাৎপর্যে বলেছেন- জীব এবং ভগবান উভয়েই চিন্ময়। তাই তাঁরা উভয়েই নিত্য, এবং তাঁদের কারোরই জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয়। তবে পার্থক্যটি হচ্ছে এই যে, ভগবানের তথাকথিত জন্ম বা আবির্ভাব এবং তিরোভাব জীবের জন্ম-মৃত্যুর মতো নয়। যে সমস্ত জীব জন্মগ্রহণ করে এবং তারপর আবার মৃত্যুবরণ করে তারা জড়া-প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা বদ্ধ। কিস্তু পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য আবির্ভাব এবং তিরোভাব জড়া-প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত নয়, তা হচ্ছে ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তির কার্য। তাঁর সেই কার্যকলাপের মহিমা মহান ঋষিরা আত্মজ্ঞান লাভের জন্য কীর্তন করে থাকেন। পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং ভগদ্গীতায় বলেছেন যে, এই জড় জগতে তাঁর তথাকথিত জন্ম এবং কর্ম সবই দিব্য, এবং তাঁর সেই কার্যকলাপ ধ্যান করার ফলে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয় এবং জীব তখন জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। শ্রুতিতেও বলা হয়েছে যে, অজন্মা যেন জন্মগ্রহণ করেন বলে মনে হয়। পরমেশ্বর ভগবানের করণীয় কিছুই নেই, কিন্তু যেহেতু তিনি সর্বশক্তিমান, তাই সব কিছুই স্বভাবিকভাবে তাঁর দ্বারাই সম্পাদিত হয়, যেন আপনা থেকেই সেগুলি হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবানের আবির্ভাব ও তিরোভাব এবং তাঁর বিভিন্ন কার্যকলাপ সবই অত্যন্ত গোপনীয়, এমন কি বৈদিক শাস্ত্রেও সেই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা হয়নি। কিন্তু তবুও বদ্ধ জীবের প্রতি তাঁর কৃপা প্রদর্শন করার জন্য ভগবান সেই সব লীলাবিলাস করেন। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ভগবানের অপ্রাকৃত কার্য়কলাপের বর্ণনার যথার্থ সদ্ব্যবহার করা, যা হচ্ছে সব চাইতে সহজ এবং সুন্দরভাবে ব্রহ্মের ধ্যান করার পন্থা।
নৈমিষারণ্যের ঋষিরা ভগবানের জন্ম-কর্ম সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৪/৯) বলেছেন-
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্তা দেহং পুনর্জন্ম িৈত মামেতি সোহর্জুন ॥
‘আমার জন্ম এবং কর্ম হচ্ছে সম্পূর্ণ দিব্য, চিন্ময়, এই ভৌতিক শক্তির উর্দ্ধে এবং যারা প্রকৃতপক্ষে আমার দিব্য লীলা এবং জন্ম সম্পর্কে জানতে পারে, তাদের আর পুনর্জন্ম হয় না এবং এই জড় জগতের বদ্ধ জীবনে আর ফিরে আসতে হয় না, তারা আমার নিত্য ধামে ফিরে যায়।’
এই ধর্মাচরণ পন্থা খুবই সহজ, অন্য সাধন ভক্তি পথ অনুসরণ করবার দরকার কি ? শুধুমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য জন্ম, কর্ম সম্বন্ধে জানা গেলেই আমাদের আর এই জন্ম মৃত্যু রূপ সংসার চক্রে ফিরে আসতে হবে না, আমরা নিত্য শরীর এবং নিত্যলোক গোলোক বৃন্দাবনে বৈকুন্ঠনাথের সেবা অধিকার পাব।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চিরন্তনভাবে বিরাজমান আছেন। তিনি তাঁর ইচ্ছামত এ জগতে আসেন এবং লীলা সংবরণ করে আরেক জগতে চলে যান এবং সেখানে আর একটি লীলা বিস্তার করেন। এটা ভগবানের নিত্যলীলা, নিত্যকালের জন্য বিরাজমান। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকে প্রকাশিত অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডে তাঁর নিত্যলীলা চলছে এবং পারমার্থিক জগৎ গোলোক-বৃন্দাবনেও তাঁর নিত্যলীলা বিরাজমান।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মাত্র পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে এ জগতে অবতরণ করেছিলেন। তার চিহ্ন আমরা দেখতে পাই- বৃন্দাবনে, দ্বারকায়, কুরুক্ষেত্রে প্রভৃতি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়। এ সমস্ত জায়গায় তিনি তাঁর অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেছেন। এমনকি প্রাগ্জ্যোতিষপুরে অর্থাৎ বর্তমান গৌহাটিতে তিনি নরকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক দিব্য লীলা প্রদর্শন করেছেন। এইভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভগবানের লীলার কাহিনী জানতে পারা যায়।
গীতায় (১৮/৫৫) একথা বলা হয়েছে-
ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্ ॥
‘ভক্তির দ্বারা কেবল স্বরূপত আমি যে রকম হই, সেরূপে আমাকে কেই তত্ত্বত জানতে পারেন। এই প্রকার ভক্তির দ্বারা আমাকে তত্ত্বত জেনে, তারপরে তিনি আমার ধামে প্রবেশ করতে পারেন।’
এখানে ‘তত্ত্বত’ অর্থে প্রকৃত ভাবে জানা বা আসল জ্ঞান। আর এই আসল জ্ঞান কার হতে পারে ? সহজ উত্তর - একমাত্র যারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। ভগবানের ভক্তরা ভগবৎ সেবায় এতই তন্ময় যে তারা একথা মনেই করতে পারে না যে ভগবৎ সেবা কষ্টকর। সে কারণেই ভগবদ্ভক্ত না হলে ভগবান কখনও বদ্ধ জীবের কাছে গোপন তত্ত্ব প্রকাশ করেন না। বহু বহু লোক গীতা, ভাগবত শাস্ত্র পড়েও ভগবানকে বুঝতে পারে না, কারণ তারা ভগবানের ভক্ত নয়। মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় তথাকথিত পন্ডিত অধ্যাপকেরা আছেন যারা গীতা পড়েন কিন্তু ভগবানকে বুঝতে পারেন না, তার কারণ হচ্ছে ভক্তরাই ভগবানকে এবং ভগবানের মুখারবিন্দ নিঃসৃত শ্রীবচনাদিকে উপলব্ধি করতে পারেন। আর ভগবদ্ভক্ত নয় তারা ভুল বোঝাবুঝি করে ধারণা উল্টো করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ভগবানের সম্পর্কে ভুল ধারনা পোষণ করে তারা ভগবানকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে। এ বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৯/১১) বলেছেন, ‘অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্’- মূঢ় ব্যক্তিরা ভগবানকে সাধারণ মানুষের মতো মনে করে। তারা মূর্খ কিছুই জানে না। ‘পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্’- কেন তারা এই রকম মনে করে ? কেননা তারা ভগবানের পরম ভাব সম্পর্কে জানে না। পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডের নাথ ও প্রভু। সে কথা তারা জানে না বলে এই রকম ভুল ধারনা করে। তারা ভগবানের সচ্চিদানন্দময় রূপ সম্বন্ধে জানে না।
তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে, কৃষ্ণভক্ত বা ভগবদ্ভক্ত কারা ? শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এর উত্তরে বললেন- সেই ভগবদ্ভক্ত যিনি নিয়ত ভগবানের দিব্য নাম, গুণ ও লীলাদি কীর্তন করেন। মহাপ্রভু তাই সমস্ত মানুষকে ভগবদ্ভক্ত হতে আহ্বান জানিয়ে বললেন ঃ ‘কীর্তনীয়া সদা হরিঃ।’ আমরা যতই হরিনাম করি ততই আমাদের দিব্য জ্ঞান লাভ হয়। আসলে আমি যদি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে চাই তবে আমাকে ভগবানে ভক্তি ও ভগবানের চরণে প্রপত্তি করতে হবে। ভক্তিমূলক সেবা না করলে ভগবানকে বোঝা যায় না। মুনি ঋষিরা বুঝতে পারেন যে, ভগবানের লীলার আনেক রহস্য আছে। বেদে যেভাবে ভগবৎ মহিমা বর্ণনা রয়েছে তাতে মূল অর্থ বোঝা যায় না। যেমন এই সমস্ত প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণনা রয়েছে যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যুগধর্ম প্রচার করবার জন্য এই কলিযুগে অবতীর্ণ হবেন। বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা এই তথ্য যথাযথ ভাবে জানতে পারি। নাম প্রচার করা মহাপ্রভুর বহিরঙ্গা কারণ। এছাড়াও অন্তরঙ্গ কারণ রয়েছে। সেই কারণটা সহজে বোঝা যায় না। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব যে ভক্তভাব নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন তার কারণ ভক্ত ভগবানকে সেবা করে কি আনন্দ পান তা উপলব্ধি করবার জন্য। এছাড়া এমন আরও অন্তরঙ্গ কারণ ছিল, যা বেদেও অজ্ঞেয় অর্থাৎ বেদে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। বেদে বলা হয়েছে, ভগবান আসবেন, যুগধর্ম পালন করবেন, হরিনাম বিলোবেন- কিন্তু ভগবানের অবতরণের আসল কারণ জানা যায় ভগবদ্ভক্তের মাধ্যমে।
ভগবান নিজেই উপদেশ দিয়েছেন যে, তিনি আদি পুরুষ, তাঁর থেকেই সমস্ত কিছুর উৎপত্তি। ব্রহ্ম সংহিতায় ব্রহ্মা বলেছেন-
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদিরাদিগোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্ ॥
তিনি আদি পুরুষ গোবিন্দ, সমস্ত কারণের পরম কারণ। তিনি সমস্ত কিছুরই উৎস। তিনি আরও বলেছেন- ‘অহং সর্বস্য প্রভবঃ’- আমার থেকেই সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়েছে, আমি সমস্ত জগতের অধীশ্বর।
কাজেই ভগবানকে সত্যিকারে যদি কেউ জানতে চায়, তাকে ভক্তিযোগ অবলম্বন করতে হবে। কেবল ভক্তিমূলক সেবার দ্বারাই পরমেশ্বর পরম দয়ালু ভগবানকে যানা যায়।
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে।
গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমোস্তু তে ॥
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ করুণা সিন্ধু, দয়ার সাগর, তিনি দয়ালু প্রভু এবং বন্ধু। তাঁর মতো পরম দয়ালু আর কেউ নেই।
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্ ।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ॥
(গীতা ৫/৬)
আমরা শান্তি খুঁজি, আমরা সবাই শান্তি চাই। কিন্তু ভগবানকে বাদ দিয়ে কখনই শান্তি লাভ করা সম্ভব নয়। কেননা ভগবান বলেছেন-“ আমাকে সমস্ত যজ্ঞ এবং তপস্যার পরম উদ্দেশ্যরূপে জান, আমি সমস্ত ব্রহ্মান্ডের অধীশ্বর। আমি সকলের সুহৃদ। যারা আমাকে এইভাবে জানে তারাই জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করতে পারে।”
ভগবানকে লাভ করা বা ভগবৎ উপলব্ধির তিনটি স্তর আছে -
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্জ্ঞানমদ্বয়ম্ ।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে॥
কোন মন্তব্য নেই