বৈষ্ণব সঙ্গের মহিমা
বহু সৌভাগ্যের ফলে ভগবানের কৃপায় জীবের সংসার বাসনা দুর্বল হয়ে পড়ে ; তখন স্বাভাবিক ভাবেই সাধুসঙ্গের স্পৃহা জন্মে। সাধুসঙ্গে কৃষ্ণকথা শ্রবণ হতে শ্রদ্ধার উদয় হয়। তীর্থ যাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈষ্ণবদের শ্রীমুখ থেকে কৃষ্ণকথা শ্রবণ। তাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় তাঁর উপদেশাবলীতে গেয়েছেন -
তীর্থফল সাধুসঙ্গ, সাধুসঙ্গে অন্তরঙ্গ.
শ্রীকৃষ্ণভজন মনোহর।
যথা সাধু, তথা তীর্থ, স্থির করি নিজ-চিত্ত,
সাধুসঙ্গ কর নিরন্তর।
যে তীর্থে বৈষ্ণব নাই, সে তীর্থেতে নাহি যাই,
কি লাভ হাটিয়া দূরদেশ
যথায় বৈষ্ণবগণ সেই স্থান বৃন্দাবন,
সেই স্থানে আনন্দ অশেষ।
ভগবদ্ভক্তির নয়টি বিধির মধ্যে শ্রবণ হল প্রথম পদ্ধতি। শ্রীল প্রভুপাদ এই শ্রবণের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, তাই পৃথিবীর প্রত্যেকটি কৃষ্ণভাবনাময় মন্দিরে সকালে এবং সন্ধ্যায় গীতা-ভাগবত পাঠের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই কৃষ্ণভাবনাময় আন্দোলনে আমরা বহু নিষ্ঠাবান, সমর্পিত প্রাণ এবং ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনরত বৈষ্ণবদের বিপুল আশীর্বাদ পেয়ে থাকি। তাঁরা শুদ্ধভাবে ভগবদ্ভক্তি সম্পাদনের চেষ্টা হরে চলেছেন। শ্রীল রূপ গোস্বামীও উপদেশামৃত গ্রন্থে বলেছেন যে, ভগবদ্ভক্তের সান্নিধ্য অর্জন করা কৃষ্ণভাবনায় অগ্রসর হওয়ার পথে ষড়বিধ পন্থার অন্যতম। এই সান্নিধ্যের সুযোগ আমাদের গ্রহণ করা দরকার। ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত এবং কৃষ্ণভাবনা সম্পর্কে বৈষ্ণবেরা যেসব প্রবচন এবং সারগর্ভ আলোচনা করে থাকেন, সেগুলি নিয়মিত শুনতে হবে। ঠিক যেমন অবৈষ্ণবদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেও নিষেধ করা হয়ে থাকে, তেমনই বৈষ্ণবদের কথা শুনতেও পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
শ্রীমদ্ভাগবতে(১১/২৬/২৬) পাওয়া যায় -
ততো দুঃসঙ্গমুৎসৃজ্য সৎসু সজ্জেত বুদ্ধিমান।
সন্ত এবাস্য চিন্দন্তি মনোব্যাসঙ্গমুক্তিভিঃ ॥
অতএব বুদ্ধিমান মানুষের উচিত সমস্ত প্রকার অসৎসঙ্গ পরিহার করে শুদ্ধভক্তদের সঙ্গ লাভ করা, যাতে তাঁদের বাক্যের দ্বারা তার মনের অত্যাধিক আসক্তি ছিন্ন হয়।
যখনই আমি শুনতে পাই যে, আমার গুরুভ্রাতারা তাঁদের প্রবচন সভায় নানা উপলব্ধির কথা বুঝিয়ে বলছেন, তা শুনে সব সময়েই আমার আত্মদর্শন প্রসারিত হয়ে উঠে। কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং নতুন পরিমন্ডল বা নতুন অর্ন্তদৃষ্টি এনে দেয় আমাদের মাঝে -যা হয়ত আমি খেয়াল করিনি কিংবা একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা লক্ষ্য করতে পারিনি। তাছাড়া এতে পরিশুদ্ধিও লাভ হয়। অতএব এই বিষয়টি নিয়ে আমার সমস্ত অনুগামীদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই যে, বৈষ্ণবদের কাছ থেকে, বিশেষ করে যাঁরা কৃষ্ণভাবনায় অনেক অগ্রণী হয়ে রয়েছেন, তাঁদের কাছ থকে কিছু শোনার প্রয়োজন আছে।
ভগবদ্ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের বড় প্রিয়, আর শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে পরম প্রিয়। ভক্ত সর্বদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবা করছেন আর শ্রীকৃষ্ণও সেবা করছেন তাঁর ভক্তমন্ডলীর। শ্রীমদ্ভাগবতের নবম স্কন্ধের চতুর্থ অধ্যায়ে ৬৩ থেকে ৬৮ শ্লোকে পরমেশ্বর শ্রীবিষ্ণু দুর্বাসা মুনিকে বলেছেন, কিভাবে তাঁর নিজের সাথে তাঁর ভক্তদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে।
শ্রীভগবান উবাচ
অহং ভক্তপরাধীনোহ্যস্বতন্ত্র ইব দ্বিজ।
সাধুভির্গ্রস্তহৃদয়ো ভক্তৈর্ভক্তজনপ্রিয়ঃ ॥
পরমেশ্বর ভগবান ব্রাহ্মণকে বললেন- আমার ভক্তেদের কাছে আমি সম্পূর্ণভাবে অধীন। আমি মোটেই স্বাধীন নই। কারণ আমার ভক্তবৃন্দ জড় বাসনা থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাসক্ত, আমি কেবল তাদেরই হৃদয় কন্দরে অধিষ্ঠান করে থাকি। কেবল আমার ভক্ত নয়, যারা আমার ভক্তদেরও ভক্ত তারাও আমার বড় প্রিয়।
নাহমাত্মানমাশাসে মদ্ভক্তৈঃ সাধুভিধিনা।
শ্রীয়ং চাত্যন্তিকং ব্রহ্মন্ যেষাং গতিরহং পরা ॥
‘হে ব্রাহ্মণকুলশ্রেষ্ঠ ! আমাকে যারা একমাত্র লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন, সেই সাধুজনদের ছাড়া, আমার অপ্রাকৃত আনন্দ আর আমার পরম ঐশ্বর্য কিছুই আমি নিজে উপভোগ করতে ইচ্ছা করি না।’
যে দারাগারপুত্রাপ্তপ্রাণান্ বিত্তমিমং পরম্ ।
হিত্বা মাং শরণং যাতাঃ কথং তাংস্ত্যক্তুমুৎসহে ॥
‘যেহেতু শুদ্ধ ভক্তগণ এই জীবনে কিংবা পরবর্তী জীবনেও জড় জাগতিক উন্নতির কোন আকাক্সক্ষা না রেখে শুধুমাত্র আমার সেবার উদ্দেশ্যে তাদের ঘরবাড়ি, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পত্তি এবং তাদের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করে থাকে, কি করে তেমন ভক্তদের আমি কখনও ত্যাগ করতে পারি ?’
ময়ি নির্বদ্ধহৃদয়াঃ সাধবঃ সমদর্শনাঃ ।
বশে কুর্বন্তি মাং ভক্ত্যা সৎপতিং যথা ॥
‘যেমন সাধ্বী মহিলারা সেবার মাধ্যমে তাঁদের সজ্জন স্বামীদের অধীনে নিয়ে আসে, শুদ্ধ ভক্তরা যাঁরা প্রত্যেকেই সমান এবং হৃদয় কন্দরে আমার প্রতিই সম্পূর্ণ আসক্ত, তঁরাও আমাকে তেমনই তাদের পূর্ণ অধীনে নিয়ে আসে।’
মৎসেবয়া প্রতীতং তে সালোক্যাদিচতুষ্টয়ম্ ।
নে চ্ছন্তি সেবয়া পূর্ণাঃ কুতোইন্যৎকালবিপ্লুতম্ ॥
‘ আমার ভক্তরা যারা আমার প্রতি প্রেমময় সেবায় নিয়োজিত হয়ে নিত্য সন্তুষ্ট থাকে, তারা মুক্তি লাভের চতুর্বিধ নীতি (সালোক্য, সারূপ্য, সামীপ্য, এবং সাষ্টি) অনুসরণেও আগ্রহী নয়, যদিও তাদের ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে আপনা হতেই এই সব মুক্তিলাভ অর্জন করা হয়ে যায়। তা হলে উচ্চতর গ্রহমন্ডলীতে উন্নীত হওয়ার যে ক্ষয়িষ্ণু সুখতৃপ্তি, তার কথা কী আর বলার আছে ?’
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধুনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জানন্তি নহিং তেভ্যো মনাগপি॥
‘শুদ্ধভক্ত সদাসর্বদাই আমার হৃদয়কন্দরে অধিষ্ঠিত থাকে, আর আমিও সর্বদাই শুদ্ধভক্তের হৃদয় মধ্যে অবস্থান করি। আমার ভক্তরা আমাকে ছাড়া আর কিছুই জানে না, এবং আমিও তাদের ছাড়া আর কাউকেই জানি না।’
(শ্রীমদ্ভাগবত ৯/৪/৬৩-৬৮)
পরমেশ্বর ভগবানের কাছে ভক্ত এমনই প্রিয় যে, ভগবান এই কথা বারে বারে শাস্ত্রাদিতে ঘোষনা করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তগণ বিশ্বব্রহ্মান্ডকে পারমার্থিক জ্যোতিতে উদ্বাসিত করে রেখেছেন। ঠিক যেমন সূর্য তার বিচ্ছুরিত কিরণালোকের মাধ্যমে বিশ্বন্রহ্মান্ডকে বহিরঙ্গারূপে জ্যোতির্ময় করে রেখেছে। সাধুরা তেমনই অপ্রাকৃত জ্ঞান বিস্তারের মাধ্যমে অপ্রাকৃত অন্তরঙ্গা জ্যোতি প্রদান করে থাকেন। এই কথা শ্রীম্ভাগবতে (১১/২৬/৩৪) শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধব সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে -
সন্তো দিশন্তি চক্ষুংসি বহিরর্কঃ সমুত্থিতঃ ।
দেবতা বান্ধবাঃ সন্তঃ স্ত আত্মাহমেব চ ।।
আমার ভক্তরা দিব্য চক্ষু দান করে, যেক্ষেত্রে সূর্য শুধুই বহিরঙ্গা দৃষ্টিক্ষমতা এনে দেয়, আর তাও যখন সে আকাশে উঠে। আমার ভক্তবৃন্দ মানুষের প্রকৃত আরাধ্য দেবমন্ডলী আর প্রকৃত পরিবার গোষ্ঠী ; তারাই মানুষের স্বরূপাত্মা, শেষ পর্যন্ত তারাই আমা হতে অভিন্ন।
তাই বৈষ্ণবদের কাছ থেকে আমরা শ্রীকৃষ্ণভাবনার অন্তরঙ্গা জ্ঞানালোক লাভ করতে পারি। ভক্ত সান্নিধ্য লাভের মূল্যায়ন কে করতে পারে ! বৈষ্ণবদের কাছ থেকে শ্রবণ করা এবং বৈষ্ণবদের সেবা করার এমনই মাহাত্ম্য। যখন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর ভক্তদের সেবা করে থাকেন, তাহলে কোন উৎসাহী ভক্তের কথা আর কী বলার আছে। ভগবানের বৈষ্ণব ভক্তদের সেবা করা কতই না জরুরী। ভগবান শ্রীবিষ্ণু আগেই বলেছেন, ‘ভক্তদের কথা আর কি বলব -এমনকি যারা আমার ভক্তেরও ভক্ত, তারাও আমার বেশি প্রিয়।’
শ্রীল প্রভুপাদ বারে বারেই নরোত্তম দাস ঠাকুরের ভক্তিগীতিটি তুলে বলতেন, যেখানে তিনি গেয়েছেন, ‘ছাড়িয়া বৈষ্ণব সেবা নিস্তার পেয়েছে কেবা’ - ভক্তের ভক্ত না হতে পারলে কখনও জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। ( শ্রীমদ্ভাগবত ৯/৪/৬৩ তাৎপর্য)
বাস্তবিকই, পদ্ম পুরাণে পরিস্কারভাবেই বলা আছে যে, কেউ যদি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীগোবিন্দের ভক্তের পূজা ও সেবা পরিত্যাগ করে সরাসরি গোবিন্দ ভজনা শুরু করে দেয়, তা হলে তাকে ভগবানের ভক্ত বলে বিবেচনা করা হয় না -
অচৈর্ত্বতু গোবিন্দ তাধিয়নর্চায় তু যঃ ।
ন স ভগবতো গেয়ঃ কেবলং দাম্ভিক স্মৃতিঃ।
তস্মাদ সর্বং প্রজত্মেন বৈষ্ণবান্ পূজয়েৎ সদা॥
পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তরূপে তাকে গণ্য করা হবে না, যে ভগবানের শুদ্ধ বৈষ্ণব ভক্তদের আরাধনা পরিথ্যাগ করেছে, এমনকি যদি সে সরাসরি গোবিন্দের ভজনাও করে থাকে। তেমন মানুষকে বৃথা অহংকারী এবং উদ্ধত বলেই জানতে হবে। অতএব অতি সযতেœ ও মনোযোগ সহকারে মানুষকে নিয়ত বৈষ্ণবগণের আরাধনা করতে হবে।
(পদ্মপুরাণ, উত্তর খন্ড)
প্রহলাদ মহারাজ তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপুকে বলেছেন -
নৈষা মতিস্তাবদুরুত্রমাঙ্ঘ্র্রিং
স্পৃশত্যনথাপর্গমো যদর্থঃ।
মহীয়সাং পাদরজোহভিষেকং
নিষ্কিঞ্চনানা ন বৃনীত যাবৎ ॥
যে সব মানুষের জড়জাগতিক জীবনের প্রতি অত্যাধিক প্রবণতা রয়েছে, তারা যদি জড় কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত কোনও বৈষ্ণবের চরণকমলরেণু তাদের সর্বাঙ্গে লেপন করতে না পারে, তা হলে অসাধারণ কার্যকলাপের মহিমামন্ডিত সেই পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি তারা আসক্ত হতে পারবে না। শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হয়ে আর এই ভাবে পরমেশ্বর ভগবানের চরণপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করেই মানুষ জড় কলুষতা থেকে মুক্ত হতে পারে।
( শ্রীমদ্ভাগবত ৭/৫/৩২)
ব্রহ্মজ্ঞ জড় ভরত মহারাজ রহুগগণকে বলেছেন -
রহুগণৈতত্তপসা ন যাতি
ন চেজ্যয়া নির্বাপণাদ গৃহাদ্বা।
নচ্ছন্দসা নৈব জলাগ্নিসূযৈ-
র্বিনা মহৎপাদরজোভিষেকম্ ॥
হে মহারাজ রহুগণ, মহাভাগবতের চরণরেণুর দ্বারা অভিষিক্ত না হলে, কখনই পরমতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা , গার্হস্থ্য -জীবনের বিধিবিধান কঠোর নিষ্ঠা সহকারে পালন করার দ্বারা, বানপ্রস্থ আশ্রমে গৃহত্যাগ করার দ্বারা অথবা, সন্ন্যাস আশ্রম অবলম্বনের দ্বারা অথবা শীতের সময়ে জলমগ্ন হয়ে অথবা গ্রীষ্মে অগ্নিপরিবেষ্টিত হয়ে কিংবা প্রখর র্সর্যকিরনে অবস্থান করে তপস্যা করার দ্বারা তাঁকে জানা যায় না। পরম সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করার অন্য পন্থা থাকলেও, মহাভাগবতের কৃপার প্রভাবেই কেবল পরম সত্য প্রকাশিত হয়।
(শ্রীমদ্ভাগবত ৫/১২/১২)
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধভক্তদের, ভগবানের সেবায় সমর্পিত প্রাণ, নিষ্ঠাবান ভক্তদের ভগবদ্ভক্তির মাহাত্ম্য সম্পর্কে অসংখ্য উল্লেখ শাস্ত্রে আছে। অবশ্যই আমি চাই আমার সকল শিষ্যসমূহ ভগবানের ভক্তবৃন্দের চরণকমলের সেবা করে, এই যে বিশেষ কৃপা লাভ করা যায়, সেই সুযোগটি তারা গ্রহণ করবে। দীক্ষাগুরুর প্রতি সেই ধরনের বিশ্বাস এবং ভালবাসা প্রত্যেক শিষ্যেরই আছে বা থাকা উচিত। তারা এইভাবেই গুরুদেবের সেবা পূজা করতে চায়। অবশ্য গুরুদেবের সেবা পূজা করা আর অন্যান্য বৈষ্ণবদের অশ্রদ্ধা করা সম্পর্কে শাস্ত্রাদিতে শতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। রামানুচার্য বিত্তবান এক শিষ্যের বাড়িতে যেতে আপত্তি করেছিলেন, কারণ তাঁর গুরুভ্রাতাদের সে খুব ভালভাবে সেবা করেনি। শিষ্যসমূহের তথাকথিত আঞ্চলিক আচার্য প্রথামলূক তত্ত্ব বিচার পরিহার করা উচিৎ, যা থেকে কেউ কেউ মনে করে যে, তার গুরুদেবই কেবল একমাত্র ভক্ত বা শুদ্ধভক্ত। গুরুদেবের প্রতি কোন শিষ্যের বিশ্বাস বিশেষ শ্রদ্ধা আর ভালবাসা থাকা মোটেই দোষের নয়। তবে নিজের গুরুদেবের প্রতি বিশেষ ভালবাসা আছে বলে ভগবানের বৈষ্ণব ভক্তদের প্রতি সেবা পরিত্যাগ করা উচিৎ নয়।
উন্নত বৈষ্ণব ভগবদ্ভক্তের কাছ থেকে শ্রবণ করা এবং তাঁদের সেবা করার মাধ্যমেই বিশেষ পরিশুদ্ধি এবং কৃপালাভের সুযোগ ঘটে। আমি চাই না যে, আমার শিষ্যসমূহ তা থেকে বঞ্চিত থাকবে। শুধুমাত্র কনিষ্ঠ অধিকারী ভক্তদেরই এমন ধারণা থাকে যে, তার গুরুই হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একমাত্র ভক্ত এবং আর কেউই ভক্ত হতে পারে না। আমি চাই অবশ্যই আমার সমস্ত শিষ্যসমূহ অন্তত মধ্যম অধিকারী পর্যায়ে উন্নীত হবে, এবং কেবল তাদের গুরুদেবের প্রতিই প্রেম ও বিশ্বাস থাকবে, তা নয় - বরং পরমেশ্বর ভগবানের সমস্ত শুদ্ধভক্তদেরই শ্রদ্ধা ভালবাসা দিতে জানবে। বহু বৈষ্ণবদের কাছ থেকে শ্রবণ করার মাধ্যমে উপদেশ গ্রহণ করতে হলে ভক্তদের মধ্যে খানিকটা বিশেষ পরিণত মনোবৃত্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রচার সম্পর্কিত দর্শনভঙ্গির মধ্যে সামান্য মতভেদগুলি সহ্য করতে শিখতে হবে। দর্শন তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে প্রত্যেক ভক্তের সামান্য কিছু মতপার্থক্য বা গুরুত্বভেদ থাকতে পারে, তবে শ্রীকৃষ্ণের মর্যাদা এবং মহিমা সম্পর্কে আর দর্শনতত্ত্বের পরম বিষয়াদি সম্পর্কে কোন মতানৈক্য থাকা অনুচিত।
আমাদের চেতনাকে শ্রীকৃষ্ণভাবনাময় দর্শনতত্ত্বে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে এবং ভগবানের শুদ্ধভক্তদের কাছ থেকে তা শোনার চেয়ে আর ভাল পন্থা কী হতে পারে। সচরাচর আমাকে প্রবচন বা ভাষণ দিতেই হয়, কিন্তু যখনই আমি সুযোগ পাই কিছু শোনবার, আমি তখন অন্যান্য ভক্তদের আলোচনা বা পর্যালোচনা থেকে বিপুল উদ্দীপনা আর অর্ন্তদৃষ্টি লাভ করে থাকি।
কোন মন্তব্য নেই