ভক্তির অধিকারী হলে স্বভাব পরিবর্তন



 (১২-১৬) অনুচ্ছেদ 

ভক্তির অধিকারী হলে স্বভাব পরিবর্তন 

(১২,সাধুসঙ্গ এবং ভক্তির ক্রম  বিচার ; ১৩-১৪, অভদ্র (বাসনা) বিনাশ ;

১৫, শ্রদ্ধাবানের প্রকার ; ১৬, আত্মদর্শনের ফল)   

         

শৃণ্বতাং স্বকথাঃ কৃষ্ণঃ পুণ্যশ্রবণকীর্তনঃ।

হৃদ্যন্তঃস্থো হ্যভদ্রাণি বিধুনোতি সুহৃৎ সতাম্ ॥ (ভাঃ ১/২/১৭) ॥১২॥

তারপর বাসুদেব-কথায় রুচি হলে সাধুগণের সুহৃৎ হরিকথার শ্রবণ ও পরে কীর্তনকারীর সুকৃতিপ্রদ কৃষ্ণ নিজকথা শ্রবণকারীজনের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে হৃদয়ের অসৎ বাসনা বিনষ্ট করেন। অর্থাৎ জীবের হরিকথা ক্রমপন্থায় শ্রবণফলে কীর্তন, কীর্তনফলে অনর্থ-নিবৃত্তি, তৎপরে ভগবান স্মরণীয় বস্তুরূপে উদিত হন। কৃষ্ণ স্বীয় কথাদ্বারা জীবের অন্তঃস্থিত হয়ে (চিন্তাপথে এসে) হৃদয়ের অভদ্র (বাসনাসমূহ) ধ্বংস করেন। ॥১২॥          

নষ্টপ্রায়েষুভদ্রেষু নিত্যং ভাগবতসেবয়া। 

ভগবত্যুত্তমশ্লোকে ভক্তির্ভবতি নৈষ্টিকী ॥ (ভাঃ ১/২/১৮) ॥১৩॥

তদন্তর হরিকথা প্রভাবে সর্বদা গ্রন্থ ও ভক্ত ভাগবত সেবাক্রমে নামাপরাধ লক্ষণ অভদ্রসমূহ বিনষ্ট প্রায় হলে উত্তমশ্লোক ভগবানে একাগ্রচিত্তময়ী ভক্তির উদয় হয়। নষ্টপ্রায় বলতে জ্ঞানের মত সম্যক নষ্ট বুঝতে হবে না। এই বাক্যে ভক্তির বাধাশূন্য স্বভাব উদিত হয়েছে। বৈষ্ণবগণের শুশ্রষা অথবা ভাগবত শাস্ত্রের শ্রবণ-পঠন-বিচারণাদি সেবা দ্বারা চিন্তা-স্মরণ ও অনুধ্যানরূপ নৈষ্ঠিকী অর্থাৎ নৈবন্তর্যময়ী (আদৌ শ্রদ্ধা ইত্যাদি) ভক্তি হয়। ॥১৩॥


তথৈব “ত্রিভুবন বিভবহতবেহপ্যকুন্ঠস্মৃতি” (ভাঃ ১১/২/৫৩)- ত্রিভুবন রাজ্যার্থ লাভের জন্য ক্ষণার্দ্ধকালও যিনি অকুন্ঠস্মৃতি (ভগবৎপাদ ব্যতীত) অন্যত্র সার নেই এরূপ অচঞ্চলা মতি বিশিষ্ট) তিনিই বৈষ্ণবাগ্রগণ্য - এই শ্লোক কথিত রীতি অনুসারে তৎকালেই যে সকল বাসনা বিনষ্ট হওয়ায় চিত্ত শুদ্ধসত্ত্বময় হয়ে ভগবৎতত্ত্ব সাক্ষাৎকার যোগ্য হয়, তা নিম্নোক্ত শ্লোকে বলছেন-


 তদা রজস্তমোভাবাঃ কামলোভাদয়শ্চ যে।

চেত এতৈরনাবিদ্ধং স্থিতং সত্ত্বে প্রসীদতি ॥ (ভাঃ ১/২/১৯) ॥১৪॥


রজস্তমোভাবময় বিক্ষেপলয়াদিও কাম-লোভাদি ছয়রিপু কর্তৃক অনাক্রান্ত হয়ে শুদ্ধসত্ত্বগুণে অবস্থানপূর্বক প্রসন্ন হয় অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বে অধিষ্ঠানের পূর্ব দশায় কোমাদিরূপতীক্ষ্ণ শরাদিবিদ্ধ চিত্তব্যাথা জর্জরিত ব্যক্তির অন্নাদি গ্রহণের ন্যায় কীর্তনাদিতে আস্বাদ লাভ করে না। রজঃ ও তমোগুণ হতে ভাবসকল কামাদি রিপুগণ দ্বারা অনভিভূত চিত্ত - এই প্রকার তন্ময়। (ভক্তি সন্দর্ভের ২৫৬ সংখ্যা প্রথম নাুঃ ভবতি) ॥১৪॥

          

এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ।

 ভগবত্তবিজ্ঞানং মুক্তসঙ্গস্য জায়তে ॥ (ভাঃ ১/২/২০) ॥১৫॥


এই প্রকার ভগবদ্ভক্তিযোগ হতে মুক্তসঙ্গ প্রসন্নচিত্ত জাতরুচিজনের ভগবত্তত্ত্ব বিজ্ঞান লাভ হয়। রতি ব্যতীত বিষয়স্পৃহা ত্যক্ত হয় না এবং মনও প্রসন্ন হয় না। তত্ত্ববিজ্ঞান শব্দে ভগবানের স্বরূপ গুণ লীলার ঐশ্বর্য-মাধুর্যানুভূতি। এইরূপে পূর্বোক্ত প্রকার দ্বারা প্রসন্নমনা মুক্তঙ্গের (অন্যাভিলাষ কর্মফলভোগ ও নির্ভেদ ব্রহ্মানুসন্ধানরূপ বন্ধন হতে মুক্ত) অর্থাৎ কামাদি বাসনাহীন ব্যক্তির ভক্তিযোগ বলে পুণরায় ভাগবত সেবা প্রভৃতি ভজনক্রিয়ানুষ্ঠান হতে বিজ্ঞান অর্থাৎ সাক্ষাৎকার জন্মে। অন্তর বা বাহ্যভাবনা ব্যতীত যে স্বতঃই অনুভব, তা-ই সাক্ষাৎকার। (কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্ছামূলে সেবকের যে নিত্যবৃত্তি ক্রিয়া (চিদেন্দ্রিয়ের) তা-ই সাক্ষাৎকার, তা-ই ভগবত্তত্ত্ব বিজ্ঞান।) ॥ ১৫॥


একমাত্র পরমানন্দ স্বরূপবলে সেই স্বভাবতঃ ফলস্বরূপ (প্রয়োজন) আনুষঙ্গিক ফল বর্ণিত হচ্ছে


ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্তিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।

ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি দৃষ্ট এবাত্মনীশ্বরে ॥ (ভাঃ ১/২/২১) ॥১৬॥


আত্মস্বরূপভূত ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার হলে অবিদ্যাহঙ্কার ধ্বংস হয়, অসম্ভবনাদিরূপ সংশয়সমূহ ছিন্ন হয় এবং অনারদ্ধ ফল ক্ষয় পায়; হৃদয় গ্রন্থিরূপ অহঙ্কার। সর্ব সংশয় ছিন্ন হয় এই বাক্যে তাঁকে দেখলেই শ্রবণ মননাদি প্রধান ভক্ত্যঙ্গ সম্বন্ধীয় সকল সংশয়ই (প্রাপঞ্চিকতয়া বুদ্ধ্যা) সমাপ্ত হয়। শ্রবণ দ্বারা জ্ঞেয় ভগবৎ সম্বন্ধে যাবতীয় অসম্ভাবনারূপ সন্দেহ বা অযোগ্যতা দূরীভূত হয়। (যমেবৈষ বৃণুতে মায়িক জ্ঞান, জ্ঞেয়-জ্ঞাতা ভেদ বৈকুন্ঠ বস্তুতে নেই) এবং মনন দ্বারা জ্ঞেয়গত বিপরীত ভাবনারূপ অস্ফূর্তি আর সাক্ষাৎকারক্রমে আত্মযোগ্যতাগত সম্ভাবনা, বিপরীত ভাবনাদ্বয় সুষ্ঠু মনন প্রভাবে সচ্চিদানন্দ বিগ্রহের বিপরীত ভাবনা যে নির্বিশিষ্টভাব তা বিদূরিত হয় এবং প্রভু দর্শনে দাসের প্রভু হবার অযোগ্যতা দূরীভূত হয়। শ্রবণ-মননাদি সাক্ষাৎকারের অভেদত্ব প্রতিপাদক উহা প্রতিকূল বা পৃথক নহে - এই উভয়ই বিনষ্ট হয়। ভগবদ ইচ্ছা মাত্রেই কর্মসমূহের ক্ষয় হয়, তাতে অজ্ঞানাভাসের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ॥১৬॥


কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.