প্রহ্লাদের প্রার্থনায় নৃসিংহদেবের ক্রোধোপশম
সপ্তম স্কন্ধ
নবম অধ্যায়
প্রহ্লাদের প্রার্থনায়
নৃসিংহদেবের ক্রোধোপশম
শ্রীনারদ উবাচ
এবং সুরাদয়ঃ সর্বে
ব্রহ্মরুদ্রপুরঃসরাঃ ।
নোপৈতুমশকম্মন্যুসংরম্ভং সুদুরাসদম্
॥ ১ ৷৷
শ্রীনারদঃ উবাচ—দেবর্ষি নারদ মুনি বললেন, এবম্ এইভাবে,
সুর-আদয়ঃ—দেবতাগণ; সর্বে—সকলে; ব্রহ্ম- রুদ্র-পুরঃ সরাঃ–ব্রহ্মা, শিব প্রমুখ; ন না; উপৈতুম্—ভগবানের সামনে যেতে; অশক —সমর্থ মন্যুসংরস্তম্—অত্যস্ত ক্রোধাবিষ্ট হয়ে; সু-দুরাসদম্–অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য (ভগবান
নৃসিংহদেব)।
অনুবাদঃ দেবর্ষি নারদ বললেন—ভগবান তখন অত্যন্ত
ক্রোধাবিষ্ট ছিলেন বলে ব্রহ্মা, রুদ্র প্রমুখ দেবতারা তাঁর সামনে যেতে সাহস করেননি।
সাক্ষাৎ শ্রীঃ প্রেষিতা দেবৈদৃষ্ট্বা তং মহদদ্ভুতম্ ।
অদৃষ্টাশ্রুতপূর্বত্বাৎ সা নোপেয়ায় শঙ্কিতা ৷৷ ২ ॥
সাক্ষাৎ–সাক্ষাৎ: শ্রীঃ —লক্ষ্মীদেবী; প্রেষিতা—ভগবানের সামনে যেতে অনুরোধ
প্রাপ্ত হয়ে; দেবৈঃ–(ব্রহ্মা, শিব প্রমুখ) সমস্ত দেবতাদের দ্বারা; দৃষ্টা—–দর্শন করে; তম্—তাঁকে (ভগবান নৃসিংহদেবকে); মহৎ—অত্যন্ত বিশাল; অদ্ভুতম—আশ্চর্যজনক; অদৃষ্ট—যা কখনও দেখা যায়নি; অশ্রুত—যা কখনও শোনা যায়নি; পূর্বত্বাৎ—পূর্বে; সা—লক্ষ্মীদেবী; ন–না, উপেয়ায়—ভগবানের সামনে গিয়েছিলেন; শঙ্কিতা—অত্যন্ত ভয়ভীত হয়ে।
অনুবাদঃ সমস্ত দেবতারা লক্ষ্মীদেবীকে
ভগবানের সামনে যেতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনিও ভগবানের এই অদৃষ্ট এবং
অশ্রুতপূর্ব অদ্ভুত রূপ দর্শন করে ভয়ভীত হওয়ার ফলে তার সামনে যেতে পারেননি।
প্রহ্লাদং প্রেষয়ামাস
ব্রহ্মাবস্থিতমস্তিকে ।
তাত প্রশময়োপেহি স্বপিত্রে কুপিতং
প্রভুম্ ॥ ৩ ॥
প্রহ্লাদম্—প্রহ্লাদ মহারাজ, প্রেষয়ামাস- অনুরোধ
করেছিলেন ব্রহ্মা অবস্থিতম্—অবস্থিত হয়ে অন্তিকে অতি নিকটে তাত–হে পুত্র: প্রশময় প্রসন্ন
করার চেষ্টা কর, উপেহি—নিকটে যাও, স্বপিত্রে কারণ
তোমার আসুরিক পিতার কার্যকলাপে, কুপিতম্ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ,
প্রভূম ভগবানকে।
অনুবাদঃ তখন ব্রহ্মা তার নিকটে
দণ্ডায়মান প্রহ্লাদ মহারাজকে অনুরোধ করেছিলেন—হে বৎস, ভগবান নৃসিংহদেব তোমার আসুরিক পিতার প্রতি
অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তার কাছে গিয়ে তুমি তাঁকে শান্ত
কর।
তথেতি শনকৈ রাজন্ মহাভাগবতোঽভকঃ ।
উপেত্য ডুবি কায়েন ননাম
বিধৃতাঞ্জলিঃ ॥ ৪ ॥
তথা—তাই হোক, ইতি—এইভাবে ব্রহ্মার বাক্য
স্বীকার করে, শনকৈঃ ধীরে ধীরে, রাজন—হে মহারাজ (যুধিষ্ঠির)
মহা-ভাগবতঃ—মহাভাগবত (প্রহ্লাদ মহারাজ), অভকঃ–বালক হওয়া সত্ত্বেও
উপেত্য-ধীরে ধীরে তাঁর কাছে গিয়ে, ভুবি—ভূমিতে, কায়েন তার দেহের
দ্বারা ননাম প্রণতি নিবেদন করেছিলেন: বিধৃত-অঞ্জলিঃ——তাঁর হাত জোড় করে।
অনুবাদঃ নারদ মুনি বললেন-হে রাজন, মহাভাগবত প্রহ্লাদ
মহারাজ একটি ছোট্ট বালক হওয়া সত্ত্বেও, ব্রহ্মার বাণী
শিরোধার্য করে ধীরে ধীরে ভগবান নৃসিংহদেবের কাছে গিয়ে ভূতলে পতিত হয়ে, কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করেছিলেন।
স্বপাদমূলে পতিতং তমর্ভকং
বিলোক্য দেবঃ কৃপয়া
পরিপ্লুতঃ ।
উত্থাপ্য তচ্ছীষ্ণদধাত্ করাম্বুজং
কালাহিবিত্রস্তুধিয়াং
কৃতাভয়ম্ ॥ ৫ ॥
স্ব-পাদ-মূলে—তার শ্রীপাদপদ্মে পতিতম—পতিত, তম্-তাকে (প্রহ্লদি)
মহারাজকে), অভকম্–বালক, বিলোক্য –দর্শন করে, দেবঃ—ভগবান নৃসিংহদেব, কৃপয়া—তার অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে
পরিপ্লুতঃ আনন্দমগ্ন হয়ে,
উত্থাপ্য—উঠিয়ে, তৎ-শীর্ষি–তার মস্তকে অদধাৎ—স্থাপন করেছিলেন, কর অম্বুজম্ তার করকমল, কাল অহি কালরূপী সর্পের (যার প্রভাবে নিমেষের মধ্যে মৃত্যু হয়), বিত্রস্ত—ভীত, ধিয়াম্—যাদের মন: কৃত-অভয়ম্ যা
অভয় দান করে।
অনুবাদঃ প্রহ্লাদ মহারাজকে তার
শ্রীপাদপদ্মে পতিত দেখে ভগবান নৃসিংহদেব করুণাস্ত্র হয়ে তাকে উত্থাপন করেছিলেন
এবং তার ভক্তদের অভয় প্রদানকারী করকমল তাঁর মস্তকে স্থাপন করেছিলেন।
স তৎকরস্পর্শধুতাখিলাশুভঃ
সপদ্যভিব্যক্তপরাত্মদর্শনঃ ।
তৎপাদপদ্মং হৃদি নিৰ্বতো দধৌ
হৃষ্যত্তনুঃ
ক্লিন্নহৃদশ্ৰুলোচনঃ ॥ ৬ ॥
সঃ–তিনি (প্রহ্লাদ মহারাজ), তৎকরস্পর্শ—তাঁর মস্তকে ভগবান
নৃসিংহদেবের করকমলের স্পর্শের ফলে, ধুত—পবিত্র হয়ে, অখিল—সমস্ত অশুভঃ অমঙ্গল অথবা জড়
বাসনা সপদি তৎক্ষণাৎ অভিব্যক্ত প্রকাশিত হয়েছিল; পর আত্মদর্শনঃ—পরমাত্মা উপলব্ধি
(দিব্যজ্ঞান), তৎ-পাদপদ্মম্ –ভগবান নৃসিংহদেবের শ্রীপাদপদ্ম; হৃদি—হৃদয়ে; নির্বৃতঃ —দিব্য আনন্দে পূর্ণ; দধেী—ধারণ করেছিলেন; হৃষ্যৎ তনুঃ—তাঁর শরীরে দিব্য আনন্দের
প্রকাশ, ক্লিন্নহৃৎ—দিব্য আনন্দের প্রভাবে যাঁর
হৃদয় দ্রবীভূত হয়েছিল;
অশ্র-লোচনঃ—–অশ্রুপূর্ণ নয়নে।
অনুবাদঃ প্রহ্লাদ মহারাজের মস্তকে
ভগবান নৃসিংহদেবের করকমলের স্পর্শের ফলে, প্রহ্লাদ মহারাজ সমস্ত জড় কলুষ এবং বাসনা
থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছিলেন, যেন তিনি তখন
সম্পূর্ণরূপে বিধৌত হয়েছিলেন। তার ফলে তিনি তখন চিন্ময় স্তরে অবস্থিত হয়েছিলেন
এবং তাঁর শরীরে চিন্ময় আনন্দের সমস্ত লক্ষণগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। তার হৃদয় ভগবৎ
প্রেমে পূর্ণ হয়েছিল, তাঁর নয়নযুগল থেকে অশ্রুধারা ঝরে
পড়ছিল, এবং তিনি তখন পরম আনন্দে ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম তার
হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন।
অস্তৌষীদ্ধরিমেকাগ্রমনসা সুসমাহিতঃ ।
প্রেমগদগদয়া বাচা
তন্ন্যস্তহৃদয়েক্ষণ ॥৭॥
অস্তৌষীৎ—তিনি প্রার্থনা নিবেদন করতে
শুরু করেছিলেন, ইরিম্ —পরমেশ্বর ভগবানকে, একাগ্র-মনসা- ভগবানের
শ্রীপাদপরে তাঁর চিত্ত সর্বতোভাবে স্থির করে। সুসমাহিতঃ—অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে (অন্য
কোন বিষয়ে বিচলিত না হয়ে); প্রেম-গদ্গদয়া–দিব্য আনন্দ অনুভবশত তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ
হওয়ার ফলে, বাচা—বচনে, তৎনাস্ত—ভগবান নৃসিংহদেবের কাছে
সম্পূর্ণরূপে নিজেকে উৎসর্গ করে, হৃদয় ঈক্ষণঃ–হৃদয় এবং দৃষ্টি।
অনুবাদঃ প্রহ্লাদ মহারাজ একাগ্র
চিত্তে সমাহিত হয়ে, ভগবান নৃসিংহদেবের প্রতি তার মন এবং দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রেম গদগদ বচনে
তাঁর স্তব করতে লাগলেন।
শ্রীপ্রহ্লাদ উবাচ
ব্রহ্মাদয়ঃ সুরগণা মুনয়োহথ সিদ্ধাঃ
সত্ত্বৈকতানগতয়ো বচসাং প্ৰবাহৈঃ ।
নারাধিতুং পুরুগুণৈরধুনাপি পিপ্রুঃ
কিং তোষ্টুমহতি স মে হরিরুগ্রজাতেঃ ॥
৮ ॥
শ্রীপ্রহ্লাদঃ উবাচ–প্রহ্লাদ মহারাজ প্রার্থনা
করেছিলেন ব্রহ্ম আদয়ঃ-ব্ৰহ্মা প্রমুখ, সুর-গণাঃ—উচ্চতর লোকের অধিবাসীগণ
মুনয়ঃ—মহান ঋষিগণ, অথ–এবং (চতুঃসন এবং অন্যেরা), সিদ্ধাঃ–পূর্ণজ্ঞান অথবা
সিদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সত্ত্ব—আধ্যাত্মিক স্থিতিতে; একতান গতয়ঃ—যাঁরা কোন রকম জড়-জাগতিক
কার্যকলাপে পথভ্রষ্ট হননি;
বচসাম্-বাণী বা বর্ণনার প্রবাহৈঃ—প্রবাহের দ্বারা ননা.
আরাধিতুম্ –প্রসন্নতা বিধান করতে
পুরু-শুণৈঃ- সম্পূর্ণরূপে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, অধুনা—এখন পর্যন্ত, অপি—যদিও, পিঞ্জঃ–সমর্থ ছিলেন, কিম্ –কি, তোষ্টম –প্রসন্ন হতে, অৰ্হতি—সমর্থ সঃ—তিনি (ভগবান), মে—আমার, হরিঃ—ভগবান, উগ্র জাতেঃ–অসুর কুলোদ্ভূত আমি।
অনুবাদঃ প্রহ্লাদ মহারাজ প্রার্থনা
করেছিলেন—অসুর কুলোদ্ভূত আমার পক্ষে
ভগবানের প্রসন্নতা বিধানের জন্য স্তব করা কি করে সম্ভব? সত্ত্বগুণান্বিত এবং
অত্যন্ত যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ব্রহ্মা আদি দেবতাগণ এবং ঋষিগণ অপূর্ব সুন্দর বাক্য
প্রবাহের দ্বারা ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করতে সক্ষম হননি, সুতরাং
আমার পক্ষে কি করে সম্ভব হবে? আমার তো কোনই যোগ্যতা নেই।
মন্যে ধনাভিজনরূপতপঃশ্ৰুতৌজ
স্তেজঃপ্রভাববলপৌরুষবুদ্ধিযোগাঃ
।
নারাধনায় হি ভবস্তি পরস্য পুংসো
ভক্ত্যা তুতোষ ভগবান্
গজযূথপায় ॥ ৯ ॥
মন্যে - আমি মনে করি, ধন - ধন-সম্পদ,
অভিজন -সম্ভ্রান্ত পরিবার, রূপ - দৈহিক
সৌন্দর্য, তপঃ- তপশ্চর্যা শ্রুত বেদ অধ্যয়ন জনিত জ্ঞান ওজঃ
ইন্দ্রিয়ের বল, তেজঃ- শরীরের তেজ, প্রভাব
প্রভাব, বল—দৈহিক শক্তি, পৌরুষ—উদ্যম, বুদ্ধি প্রজ্ঞা, যোগাঃ—যোগশক্তি ননা, আরাধনায়–প্রসন্নতা বিধানের জন্য, হি—বস্তুতপক্ষে, ভবন্তি—হয়, পরস্য—চিন্ময়, পুংসঃ–ভগবানের ভক্ত্যা—কেবল ভক্তির দ্বারা তুতোষ—সন্তুষ্ট হয়েছিলেন; ভগবান্ –পরমেশ্বর ভগবান গজ-যূথপায়–গজেন্দ্রের প্রতি।
অনুবাদঃ প্রহ্লাদ মহারাজ বললেন- আমি
মনে করি যে ধন-সম্পদ, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম, তপস্যা, পাণ্ডিত্য, ইন্দ্ৰিয়নৈপুণ্য তেজ, প্রতাপ, শারীরিক বল, পৌরুষ,
বুদ্ধি, এবং যোগশক্তি, এই
সমস্ত গুণের দ্বারাও ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করা যায় না। ভগবান কেবল ভক্তির
দ্বারাই প্রসন্ন হন। এই সমস্ত গুণে গুণান্বিত না হলেও গজেন্দ্র কেবল ভক্তির
দ্বারাই ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করেছিলেন।
বিপ্রাদ দ্বিষড়গুণযুতাদরবিন্দনাভ-
পাদারবিন্দবিমুখাৎ শ্বপচং
বরিষ্ঠম্ ।
মন্যে তদর্পিতমনোবচনেহিতার্থ-
প্রাণং পুনাতি স কুলং ন তু
ভূরিমানঃ ॥ ১০ ॥
বিপ্লাৎ—ব্রাহ্মণ থেকে; দ্বি-ষট্ গুণ-যুতাৎ–বারোটি ব্রাহ্মণোচিত গুণে
গুণান্বিত; অরবিন্দনাভ—কমলনাভ ভগবান শ্রীবিষ্ণু, পাদ-অরবিন্দ ভগবানের
শ্রীপাদপদ্মে বিমুখাৎ—ভক্তিবিমুখ; শ্বপচম্—নিম্ন কুলোদ্ভূত বা চণ্ডাল, বরিষ্ঠম্—শ্ৰেষ্ঠ মন্যে আমি মনে করি
তৎ-অর্পিত ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের শরণাগত, মনঃ—মন, বচন বাণী, ঈহিত—প্রতিটি প্রচেষ্টা, অর্থ সম্পদ, প্রাণম্ এবং জীবন, পুনাতি—পবিত্র করে সঃ–তিনি (ভক্ত), কুলম্—তাঁর পরিবার, ন না, তৃ—কিন্তু, ভূরিমানঃ –যে ব্যক্তি বৃথাই নিজেকে
উচ্চপদে অবস্থিত বলে মনে
অনুবাদঃ (সনৎসুজাত গ্রন্থে বর্ণিত)
বারোটি ব্রাহ্মণোচিত গুণে ভূষিত অথচ ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম বিমুখ অভক্ত ব্রাহ্মণ
অপেক্ষা যার মন, বাক্য, কর্ম, ধন এবং প্রাণ
ভগবানে অর্পিত, সেই চণ্ডালও শ্রেষ্ঠ। এই প্রকার ভক্ত সেই রকম
ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, কারণ ভক্ত তার কুল পবিত্র করতে
পারে, কিন্তু সেই অতি গর্বান্বিত ব্রাহ্মণ নিজেকেও পবিত্র
করতে পারে না।
নৈবাত্মনঃ প্রভুরয়ং নিজলাভপূর্ণো
মানং জনাদবিদুষঃ করুণো
বৃণীতে ৷
যদ্ যজ্জনো ভগবতে বিদধীত মানং
তচ্চাত্মনে প্রতিমুখস্য যথা
মুখশ্রীঃ॥ ১১ ॥
ন–না; এব—নিশ্চিতভাবে, আত্মনঃ—ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রভুঃ
ভগবান; অম্—এই নিজলাভ-পূর্ণঃ—যিনি সর্বদা নিজেতেই প্রসন্ন
(তাঁর প্রসন্নতা বিধানের জন্য অন্যের সেবার প্রয়োজন হয় না), মানম্ —পূজা, জনাৎ—কোন ব্যক্তি থেকে, অবিদুষঃ—যে ব্যক্তি জানে না যে, জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে
ভগবানের প্রসন্নতা বিধান। করা, করুণঃ–অজ্ঞানী মূর্খদের প্রতি যিনি
অত্যন্ত করুণাময় (ভগবান);
বৃণীতে—স্বীকার করেন; যত্ যৎ–যা কিছু জনঃ –ব্যক্তি, ভগবতে—ভগবানকে, বিদধীত—নিবেদন করতে পারেন মানম্—পূজা, তৎ–তা, চ–বক্তৃতপক্ষে, আত্মনে—তার নিজের লাভের জন্য প্রতিমুখস্য-দর্পণে
মুখের প্রতিবিম্ব, যথা—যেমন, মুখশ্রীঃ—মুখের সৌন্দর্য।
অনুবাদঃ ভগবান সর্বদাই সর্বতোভাবে
আত্মতৃপ্ত। তাই কেউ যখন তাঁকে কিছু নিবেদন করেন, তখন সেই ভক্তের মঙ্গলের জন্যই ভগবান
তা কৃপাপূর্বক গ্রহণ করেন। ভগবানের কারও সেবার প্রয়োজন হয় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা
যায় যে, নিজের মুখের সৌন্দর্যই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়
(অর্থাৎ ভগবানের মারাধনার ফলে নিজেরই মঙ্গল হয়)।
তস্মাদহং বিগতবিক্লব ঈশ্বরস্য
সর্বাত্মনা মহি গৃণামি
যথামনীষম্ ।
নীচোঽজয়াগুণবিসর্গমনুপ্রবিষ্টঃ
পুয়েতযেন হি
পুমাননুবর্ণিতেন ৷৷ ১২
তস্মাৎ—–অতএব, অহম্ –আমি; বিগত-বিক্লবঃ অযোগ্য
হওয়ার চিন্তা পরিত্যাগ করে: ঈশ্বরস্য—পরমেশ্বর ভগবানের সর্ব-আত্মনা—সর্বতোভাবে শরণাগত হয়ে; মহি—যশ, ঘৃণামি—আমি কীর্তন করব অথবা বর্ণনা
করব, যথা-মনীষম্—আমার বুদ্ধি অনুসারে, নীচঃ—নীচ কুলোদ্ভূত হওয়া
সত্ত্বেও (যেহেতু আমার পিতা সমস্ত সদ্গুণ রহিত এক মহা অসুর), অজয়া—অবিদ্যার ফলে গুণ-বিসর্গম্ –জড় জগৎ (যেখানে জীবেরা জড়া
প্রকৃতির কলুষ অনুসারে জন্মগ্রহণ করে); অনুপ্রবিষ্টঃ—প্রবিষ্ট হয়ে, পুয়েত—পবিত্র হতে পারে, যেন যার দ্বারা
(ভগবানের মহিমা); হি—বস্তুতপক্ষে, পুমান্—মানুষ; অনুবর্ণিতেন—কীর্তন অথবা পাঠ করার ফলে।
অনুবাদঃ অতএব, অসুরকুলে জন্মগ্রহণ
করলেও আমার বুদ্ধি এবং পূর্ণ প্রয়াস অনুসারে আমি শঙ্কা পরিত্যাগপূর্বক ভগবানের
মহিমা বর্ণনা করব। ভগবানের মহিমা শ্রবণ বা পাঠ করলে অবিদ্যাবশত এই জড় জগতে
প্রবিষ্ট মানুষও পবিত্র হয়।
সর্বে হামী বিধিকরাস্তব সত্ত্বধান্নো
ব্রহ্মাদয়ো বয়মিবেশ ন
চোদ্বিজন্তঃ ।
ক্ষেমায় ভূতয় উতাত্মসুখায় চাস্য
বিক্রীড়িতং ভগবতো
রুচিরাবতারৈঃ ॥ ১৩ ॥
সর্বে—সমস্ত; হি—নিশ্চিতভাবে; অমী—–এই সমস্ত বিধি-করাঃ-আদেশ
পালনকারী; তব আপনার সত্ত্ব-ধামঃ—সর্বদা চিৎ-জগতে স্থিত হয়ে ব্রহ্ম আদয়ঃ—ব্রহ্মা আদি দেবতাগণ; বয়ম্—আমরা, ইব—সদৃশ, ঈশ—হে ভগবান: ন—না; চ–এবং; উদ্বিজন্ত: (আপনার
ভয়ঙ্কর রূপের) ভয়ে ভীত, ক্ষেমায়—রক্ষার জন্য; ভূতয়ে—বৃদ্ধির জন্য; উত—বলা হয়, আত্ম-সুখায়—এই প্রকার লীলার দ্বারা
নিজের প্রসন্নতা বিধানের জন্য: চ–ও;
অস্য—এই (জড় জগতের); বিক্ৰীড়িতম্—প্রকাশিত; ভগবতঃ—ভগবানের, অবতারৈঃ—আপনার অবতারদের দ্বারা।
অনুবাদঃ হে ভগবান, ব্রহ্মা আদি সমস্ত
দেবতারা চিন্ময় স্থিতিতে অবস্থিত আপনার নিষ্ঠাপরায়ণ সেবক। তাই তারা আমাদের মতো
নন (প্রহ্লাদ এবং তাঁর আসুরিক পিতা হিরণ্যকশিপু)। এই ভয়ঙ্কর রূপে আপনার আবির্ভাব
আপনার নিজের আনন্দ বিধানের জন্য আপনারই লীলাবিলাস। আপনার এই প্রকার অবতার জগতের
মঙ্গল এবং শ্রীবৃদ্ধির জন্য।
তদ যচ্ছ মন্যুমসুরশ্চ হতস্ত্বয়াদ্য
মোদেত সাধুরপি
বৃশ্চিকসপহত্যা ।
লোকাশ্চ নিবৃতিমিতাঃ প্রতিয়স্তি
সর্বে
রূপং নৃসিংহ বিভয়ায় জনাঃ
স্মরন্তি ॥ ১৪ ॥
তৎ—অতএব, যচ্ছ দয়া করে পরিত্যাগ করুন: মন্যুম-
আপনার ক্রোধ, অসুরঃ—আমার পিতা মহা অসুর হিরণ্যকশিপু চ–ও হতঃ —নিহত, ত্বয়া আপনার দ্বারা,
অদ্য- আজ, মোদেত আনন্দিত হন, সাধুঃ অপি—সাধু ব্যক্তিও বৃশ্চিক সর্প
হত্যা—সর্প অথবা বৃশ্চিককে হত্যা
করে লোকাঃ সমস্ত লোক, চ–বস্তুতপক্ষে, নিবৃতিম—আনন্দ, ইতাঃ–প্রাপ্ত হয়েছে, প্রতিয়ন্তি—অপেক্ষা করছে (আপনার ক্রোধ
উপশমের জন্য), সর্বে–তারা সকলে রূপম –রূপ নৃসিংহ –হে ভগবান নৃসিংহদেব বিভয়ায়
তাদের ভয় নিবারণের জন্য জনাঃ- ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত লোকেরা, স্মরন্তি—স্মরণ করবে।
অনুবাদঃ হে ভগবান নৃসিংহদেব, তাই, আপনি এখন আপনার ক্রোধ সম্বরণ করুন, কারণ আমার পিতা
মহা অসুর হিরণ্যকশিপু এখন নিহত হয়েছে। সাধু ব্যক্তিও যেমন সৰ্প অথবা বৃশ্চিক
হত্যা করে আনন্দিত হন, সমগ্র জগৎ এই অসুরের মৃত্যুতে পরম
সন্তোষ লাভ করেছে। এখন তারা তাদের সুখ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছে, এবং ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা সর্বদা আপনার এই মঙ্গলময় অবতারকে
স্মরণ করবে।
নাহং বিভেম্যজিত তেঽতিভয়ানকাস্য-
জিহ্বার্কনেত্রভ্রুকুটীরভসোগ্রদংষ্ট্রাত্।
আস্ত্রস্রজঃক্ষতজকেশরশঙ্কুকর্ণা-
ন্নিহ্রাদভীতদিগিভাদরিভিন্নখাগ্রাৎ
॥ ১৫ ॥
ন—না, অহম্—আমি, বিভেমি ভীত, অজিত—হে পরম বিজয়ী, যাঁকে কেউ কখনও
পরাজিত করতে পারে না, তে আপনার অতি—অত্যস্ত, ভয়ানক ভয়ঙ্কর;
আস্য—মুখ, জিহ্বা—জিহ্বা, অর্ক-নেত্র–সূর্যের মতো উজ্জ্বল নেত্র:
ভ্রুকুটী—ভ্রূকুটি, রভস- প্রবল, উগ্র দংষ্ট্ৰাৎ ভয়ঙ্কর দত্ত, আসু-অজঃ অন্ত্রের মালা
পরিহিত; ক্ষতজ—রক্তাক্ত, কেশর–কেশর, শঙ্কু-কৰ্ণাৎ–উন্নত কৰ্ণ, নিহাদ আপনার গর্জনের
দ্বারা ভীত—ভয়ভীত, দিগিভাৎ—বিশাল দিগ্হস্তীগণ পর্যন্ত
অরিভিৎ—শত্রু বিদীর্ণকারী, নখ-অগ্রাৎ-নখাগ্র
থেকে।
অনুবাদঃ হে অজিত ভগবান, আপনার অত্যন্ত
ভয়ঙ্কর মুখ, জিহ্বা, সূর্যের মতো
উজ্জ্বল নেত্র অথবা ভ্রূকুটিভঙ্গির ভয়ে আমি ভীত নই। আমি আপনার তীক্ষ্ণ দত্ত,
অন্ত্রের মালা, রক্তাক্ত কেশর অথবা উন্নত
কর্ণের ভয়ে ভীত নই। এমন কি আপনার যে গর্জনের ফলে দিগগজেরা পলায়ন করে অথবা যে
নখাগ্রের দ্বারা শত্রুরা বিনাশ প্রাপ্ত হয়, তার ভয়েও আমি
ভীত নই।
ত্রস্তোঽস্ম্যহংকৃপণবৎসলদুঃসহোগ্র-
সংসারচক্রকদনাদ গ্রসতাং
প্ৰণীতঃ ।
বদ্ধঃ স্বকর্মভিরুশত্তম তেঽঘিমূলং
প্রীতোঽপবর্গশরণংহুয়সেকদানু৷৷১৬
ত্রস্তঃ—ভীত, অস্মি—হই অহম্ আমি, কৃপণ বৎসল –হে আধ্যাত্মিক জ্ঞানরহিত
পতিত জীবদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু প্রভু, দুঃসহ–অসহা, উগ্র –ভয়ঙ্কর, সংসার চক্র–জন্ম-মৃত্যুর চক্রের কদনাৎ
দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে, গ্রসতাম্―পরস্পরকে গ্রাসকারী বদ্ধ জীবদের মধ্যে প্রণীতঃ–নিক্ষিপ্ত হয়ে, বদ্ধঃ—আবদ্ধ, স্ব-কর্মভিঃ—আমার কর্মের ফলের দ্বারা, উশত্তম—হে দুর্জয়, তে–আপনার; অক্সি মূলম্—শ্রীপাদপদ্মের তলদেশ প্রীতঃ
(আমার প্রতি) প্রসন্ন হয়ে;
অপবর্গ শরণম্ —যা জড় জগতের ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার আশ্রয়, হয়সে আপনি আমাকে
আহ্বান করবেন, কদা—কখন; নু—বস্তুতপক্ষে।
অনুবাদঃ হে পরম শক্তিমান, পতিত-বৎসল, দুর্জয় প্রভু, আমার কর্মের ফলে আমি অসুরদের মধ্যে
নিক্ষিপ্ত হয়েছি এবং তাই এই দুঃসহ সংসার চক্রে অত্যন্ত ভীত হয়েছি। কবে আপনি আমার
প্রতি প্রসন্ন হয়ে ভব-বন্ধন থেকে মুক্তির আশ্রয় আপনার পাদমূলে আমাকে আহ্বান
করবেন?
যস্মাৎ প্রিয়াপ্রিয়বিয়োগসংযোগজন্ম-
শোকাগ্নিনা সকলযোনিষু
দহ্যমানঃ ।
দুঃখৌষধং তদপি দুঃখমতদ্ধিয়াহং
ভূমন্ ভ্রমামি বদ মে তব
দাস্যযোগম্ ৷৷১৭৷৷
যম্মাৎ—যার ফলে (এই জড় জগতের
অস্তিত্বের ফলে); প্রিয়—প্রিয়, অপ্রিয়—অপ্রিয়, বিয়োগ–বিচ্ছেদ; সংযোগ—এবং মিলনের দ্বারা জন্ম—যার জন্ম, শোকাঘিনা—শোকরূপ অগ্নির দ্বারা; সকল যোনিষু—যে কোন প্রকার শরীরে; দহ্যমানঃ—দগ্ধ হয়ে; দুঃখ ঔষধম্ দুঃখময়
জীবনের উপশমের উপায়; তৎ—তা, অপি–ও, দুঃখম্—কষ্ট, অতৎ-ধিয়া—দেহটিকে নিজের স্বরূপ বলে
মনে করার ফলে; অহম্—আমি; ভূমন্ –হে মহান; ভ্ৰমামি
(জন্ম-মৃত্যুর চক্রে) আমি ভ্রমণকরছি, বদ—–দয়া করে আপনি উপদেশ দিন মে—আমাকে; তব —–আপনার, দাস্যযোগম্—সেবাকার্য।
অনুবাদঃ হে মহান্, হে পরমেশ্বর ভগবান,
প্রিয় এবং অপ্রিয় পরিস্থিতির সংযোগের ফলে এবং তার সংযোগ ও
বিয়োগের ফলে জীবকে স্বর্গ অথবা নরকের অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয়ে
শোকাগ্নিতে দগ্ধ হতে হয়। যদিও এই দুঃখময় জীবনের নিবৃত্তি সাধনের বহু উপায়
রয়েছে। কিন্তু সেই সমস্ত উপায়গুলি সেই দুঃখদায়ক পরিস্থিতি থেকেও অধিক দুঃখজনক।
তাই আমি মনে করি যে, তার একমাত্র নিরাময় হচ্ছে আপনার সেবায়
যুক্ত হওয়া দয়া করে আপনি আমাকে সেই সেবার উপদেশ প্রদান করুন।
সোহহং প্রিয়স্য সুহৃদঃ পরদেবতায়া
লীলাকথাস্তব নৃসিংহ
বিরিঞ্চগীতাঃ ।
অস্তিতমনুগণন্ গুণবিপ্রমুক্তো
দুর্গাণি তে
পদযুগালয়হংসসঙ্গঃ ॥ ১৮ ॥
সঃ—সেই অহম্ –আমি (প্রহ্লাদ মহারাজ), প্রিয়স্য—প্রিয়তমের সুহৃদ:–শুভাকাঙ্ক্ষী, পরদেবতায়াঃ–পরমেশ্বর ভগবানের লীলাকথাঃ
লীলার বর্ণনা তব–আপনার, নৃসিংহ –হে ভগবান নৃসিংহদেব, বিরিঞ্চ-গীতাঃ —পরম্পরার ধারায় ব্রহ্মা
কর্তৃক প্রদত্ত, অঞ্জ: অনায়াসে তিতমি—আমি উত্তীর্ণ হব, অনুগণন—নিরন্তর বিশেষভাবে মুক্ত হওয়ার
বর্ণনা করে, গুণ—জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা, বিপ্রমুক্তঃ–ফলে দুর্গাণি—জীবনের সমস্ত দুঃখময়
পরিস্থিতি তে আপনার পদযুগ-আলয়—শ্রীপাদপদ্মের ধ্যানে সম্পূর্ণরূপে মগ্ন হংস-সঙ্গঃ –হংস বা মুক্ত পুরুষদের সঙ্গ
প্রভাবে।
অনুবাদঃ হে ভগবান নৃসিংহদেব, মুক্ত পুরুষদের
(হংস) সঙ্গে আপনার দিবা প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হয়ে আমি জড়া প্রকৃতির তিন গুণের
প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে কলুষমুক্ত হব এবং তার ফলে আমার অত্যন্ত প্রিয় প্রভু
আপনার মহিমা কীর্তন করতে সক্ষম হব। আমি ব্রহ্মার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর পরম্পরায়
আপনার মহিমা কীর্তন করব। এইভাবে আমি অনায়াসে ভবসাগর উত্তীর্ণ হব।
বালস্য নেহ শরণং পিতরৌ নৃসিংহ
নাতস্য চাগদমুদন্বতি মজ্জতো নৌঃ ৷
তপ্তস্য তৎপ্রতিবিধিৰ্ষ ইহাঞ্জসেষ্ট-
স্তাবদ্ বিভো তনুভূতাং
ত্বদুপেক্ষিতানাম্ ৷৷ ১৯ ৷৷
বালস্য—একটি ছোট শিশুর, ন–না, ইহ—এই জগতে, শরণম্ —–আশ্রয় (বক্ষা), পিতরৌ–পিতা এবং মাতা, নৃসিংহ—হে ভগবান নৃসিংহদেব, ন না; আর্দ্রস্য—রোগাক্রান্ত ব্যক্তির, চ–ও, অগদম্ –ঔষধ, উদন্বতি—সমুদ্রের জলে; মজ্জতঃ—নিমজ্জমান ব্যক্তির, নৌঃ –নৌকা; তপ্তস্য –জড়-জাগতিক দুঃখ-দুর্দশায়
পীড়িত ব্যক্তির, তৎ-প্রতিবিধিঃ –(সংসার ক্লেশ নিবারণের) প্রতিকার, যঃ—যা, ইহ—এই জড় জগতে; অঞ্জসা—অতি সহজে, ইষ্টঃ(প্রতিবিধানরূপে)
স্বীকৃত, তাবৎ—তেমনই, বিভো—হে পরমেশ্বর ভগবান; অনুভূতাম্ জড়
দেহধারী জীবদের; ডুৎ উপেক্ষিতানাম্—যারা আপনার দ্বারা উপেক্ষিত।
অনুবাদঃ হে নৃসিংহদেব, হে বিভো, দেহাত্মবুদ্ধির ফলে আপনার দ্বারা উপেক্ষিত দেহধারী জীবেরা তাদের নিজেদের
কল্যাণের জন্য কিছুই করতে পারে না। তারা তাদের দুঃখ নিবারণের যে উপায়ই গ্রহণ করে
তা সাময়িকভাবে লাভজনক হলেও, ক্ষণস্থায়ী। যেমন, পিতা এবং মাতা তাদের শিশুকে রক্ষা করতে পারে না, চিকিৎসক
এবং ঔষধ রোগীর কষ্ট দূর করতে পারে না, এবং তরণি সমুদ্রে
নিমজ্জমান ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারে না।
যস্মিন্ যতো যহি যেন চ যস্য যম্মাদ্
যস্মৈ যথা যদুত যত্নপরঃ পরো
বা।
ভাবঃ করোতি বিকরোতি পৃথকৃস্বভাবঃ
সঞ্চোদিতস্তদখিলং ভবতঃ
স্বরূপম্ ৷৷ ২০ ৷৷
যস্মিন্—জীবনের যে কোন অবস্থাতেই; যতঃ—কোন কারণে; যৰ্হি (অতীত,
বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ) কোন কালে, যেন–কোন কিছুর দ্বারা, চ–ও; যস্য –কারও সম্পর্কে, যম্মাৎ—কোন কারণ থেকে; যম্মৈ—কারও প্রতি (স্থান, কাল অথবা পাত্র
নির্বিশেষে); যথা—কোন উপায়ে যৎ—যাই হোক না কেন; উত—নিশ্চিতভাবে; যঃ—যে কেউ, তু–কিন্তু, অপরঃ —অন্য; পরঃ —পরম, বা—অথবা, ভাবঃ—হয়ে; করোতি করে; বিকরোতি—পরিবর্তন করে পৃথক্ –ভিন্ন; স্বভাবঃ—প্রকৃতি (জড়া প্রকৃতির
বিভিন্ন গুণের বশীভূত হয়ে), সঞ্চোদিতঃ—প্রভাবিত হয়ে, তৎ—তা অখিলম্ –সমস্ত ভবতঃ আপনার, স্বরূপম্ –আপনার বিভিন্ন শক্তিসদ্ভূত।
অনুবাদঃ হে প্রভু, এই জড় জগতে সকলেই
সত্ত্ব, রজ এবং তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জড়া প্রকৃতির
নিয়ন্ত্রণাধীন। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত সকলেই এই গুণের
বশীভূত হয়ে কর্ম করে। তাই এই জড় জগতে সকলেই আপনার প্রকৃতির বশীভূত। যে কারণে
তারা কর্ম করে যে স্থানে তারা কর্ম করে, যে সময়ে তারা কর্ম
করে, যে পদার্থ নিয়ে তারা কর্ম করে, তাদের
জীবনের যে উদ্দেশ্যকে তারা চরম বলে বিবেচনা করেছে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের উপায়—তা সবই আপনারই শক্তির
প্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে, যেহেতু শক্তি এবং শক্তিমান অভিন্ন, তাই সেই সবই
আপনারই প্রকাশ।
মায়া মনঃ সৃজতি কর্মময়ং বলীয়ঃ
কালেন চোদিতগুণানুমতেন পুংসঃ
।
ছন্দোময়ং যদজয়ার্পিতষোড়শারং
সংসারচক্রমজ কোঽতিতরেৎত্বদন্যঃ৷৷২১॥
মায়া—ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি, মনঃ—মন; সৃজতি—সৃষ্টি করে কর্ম-ময়ম্ –শত-সহস্র বাসনার সৃষ্টি করে
এবং সেই অনুসারে আচরণ করে,
বলীয়ঃ—অত্যন্ত শক্তিশালী, দুর্জয়; কালেন—কালের দ্বারা; চোদিত-গুণ—যার তিনটি গুণ বিক্ষুব্ধ হয়, অনুমতেন কৃপাদৃষ্টির
দ্বারা (কালের দ্বারা) অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে পুংসঃ–ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশ
শ্রীবিষ্ণুর, ছন্দোময়ম–বেদের নির্দেশের দ্বারা
প্রভাবিত, যৎ—যা, অজয়া—অজ্ঞানের অন্ধকারের ফলে
অর্পিত নিবেদিত; ষোড়শ–ষোল, অরম্—–অর; সংসার চক্রম—বিভিন্ন যোনিতে বার বার
জন্ম-মৃত্যুর চক্র, অজ–হে জন্মৱহিত ভগবান, কঃ কে (রয়েছে),
অতিতরেৎ–বের হতে সক্ষম: তৃৎ অন্যঃ—আপনার শ্রীপাদপদ্মের শরণ গ্রহণ না করে।
অনুবাদঃ হে ভগবান, হে পরম শাশ্বত,
আপনার স্বীয় অংশ বিস্তার করে কালের দ্বারা ক্ষোভিত আপনার বহিরঙ্গা
শক্তির মাধ্যমে আপনি জীবের সূক্ষ্ম শরীর সৃষ্টি
করেছেন। এইভাবে মন বৈদিক কর্মকাণ্ডের
নির্দেশ এবং যোলটি উপাদানের দ্বারা অন্তহীন বাসনার বন্ধনে জীবকে বেঁধে রাখে। আপনার
শ্রীপাদপদ্মের শরণ গ্রহণ বিনা এই বন্ধন থেকে কে মুক্ত হতে পারে?
স ত্বং হি নিত্যবিজিতাত্মগুণঃ
স্বধান্না
কালো
বশীকৃতবিসৃজ্যবিসর্গশক্তিঃ ।
চক্রে বিসৃষ্টমজয়েশ্বর ষোড়শারে
নিষ্পীড্যমানমুপকর্ষ বিভো প্রপন্নম্
৷৷ ২২
সঃ—সেই ব্যক্তি (সেই পরম স্বতন্ত্র
ব্যক্তি, যিনি তাঁর বহিরঙ্গা শক্তির মাধ্যমে মন সৃষ্টি করেছেন, যা এই জড় জগতে সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার কারণ), ত্বম্ –আপনি (হন): হি—বস্তুতপক্ষে, নিত্য—নিত্য, বিজিত-আত্ম–বিজিত, গুণঃ–যার বুদ্ধির গুণ, স্ব ধাম্না—আপনার নিজের চিৎ-শক্তির
দ্বারা কালঃ—কাল (যা সৃষ্টি করে এবং
সংহার করে); বশীকৃত আপনার অধীন, বিসৃজ্য—যে সমস্ত প্রভাবের দ্বারা, বিসর্গ—এবং সমস্ত কারণ, শক্তিঃ—সমস্ত শক্তি চক্রে কালচক্রে
(জন্ম-মৃত্যুর চক্রে); বিসৃষ্টম্—প্রক্ষিপ্ত হয়ে; অজয়া আপনার
বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা, তমোগুণের দ্বারা; ঈশ্বর—হে পরম নিয়ন্তা ষোড়শ অরে—ষোলটি অর সমন্বিত (পঞ্চ
মহাভূত, দশেন্দ্রিয়
এবং অন্তরেন্দ্রিয় মন), নিষ্পীড্যমানম্ (চাকার নিচে)
নিষ্পেষিত হয়ে; উপকর্ষ দয়া করে আমাকে গ্রহণ করুন (আপনার
শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয়ে); বিভো–হে মহত্তম প্রপল্লম্–সর্বতোভাবে আপনার শরণাগত।
অনুবাদঃ হে প্রভু, হে বিভো, আপনি ষোলটি উপাদানের দ্বারা এই জড় জগৎ করেছেন, কিন্তু
আপনি তাদের জড় গুণের অতীত। অর্থাৎ, এই জড় গুণ সর্বতোভাবে
আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন এবং আপনি কখনও তাদের দ্বারা পর হন না। তাই, কাল আপনার প্রতিনিধিত্ব করে। হে প্রভু হে পরমেশ্বর অজেয়, আমি কালচক্রে নিষ্পেষিত এবং তাই আমি সর্বতোভাবে আপ শরণাগত হয়েছি, এখন দয়া করে আপনি আমাকে আপনার শ্রীপাদপদ্মের আ গ্রহণ করুন।
দৃষ্টা ময়া দিবি বিভোঽখিলধিষ্ণ্যপানা-
মায়ুঃশ্রিয়োবিভবইচ্ছতিযাঞ্জনোঽয়ম্।
যেঽস্মৃৎপিতৃঃকুপিতহাসবিজুস্তিতভ্রূ
বিস্ফূর্জিতেনলুলিতাঃসতুতেনিরস্তঃ৷৷২৩৷৷
দৃষ্টাঃ—ব্যবহাবিকভাবে দর্শন করে, ময়া আমার দ্বারা,
দিবি স্বর্গলোকে, বিভো—হে ভগবান, অখিল—সমগ্র ধিক্কা-পানাম্ –বিভিন্ন রাষ্ট্রের পালকদের
আয়ুঃ—আয়ু, শ্রিয়ঃ—ঐশ্বর্য; বিভবঃ—মহিমা, প্রভাব, ইচ্ছতি বাসনা করে, যান্—যে সব; জনঃ অয়ম্ –এই সমস্ত জনসাধারণ, যে–যে সব (আয়ু, ঐশ্বর্য ইত্যাদি),
অম্মৎ পিতৃঃ——আমার পিতা হিরণ্যকশিপুর, কুপিত হাস—ক্রুদ্ধ হাসোর দ্বারা, বিস্তৃস্তিত—বিস্ফারিত, জ–র বিস্ফূর্জিতেন—কেবল তার দর্শনের দ্বারা।
লুলিতাঃ—বিধ্বস্ত, সঃ—তিনি (আমার পিতা) তৃ–কিন্তু, তে–আপনার দ্বারা, নিরস্তঃ—সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে।
অনুবাদঃ হে ভগবান, মানুষ সাধারণত দীর্ঘ
আয়ু, ঐশ্বর্য এবং সুখভোগের জন্য স্বর্গলোকে উন্নীত হতে চায়,
কিন্তু আমার পিতার কার্যকলাপের দ্বারা আমি তা দেখেছি।আমার পিতা যখন
ক্রুদ্ধ হয়ে ব্যঙ্গভরে অট্টহাস্য করত, তখন তার ভ্রুকুটি
দর্শন করে দেবতারা বিনষ্ট হত। কিন্তু আমার সেই পিতা, যিনি এত
শক্তিশালী ছিলেন, তিনি এখন নিমেষের মধ্যে আপনার দ্বারা বিনাশ
প্রাপ্ত হয়েছেন।
তস্মাদস্তনুভূতামহমাশিষোঽজ্ঞ
আয়ুঃ শ্রিয়ং বিভবমৈন্দ্রিয়মাবিরিষ্ক্যাৎ
।
নেচ্ছামি তে বিলুলিতানুরুবিক্রমেণ
কালাত্মনোপনয় মাং নিজভৃত্য
পার্শ্বম্ ॥ ২৪ ॥
তস্মাৎ অতএব, অমৃঃ –সেই সমস্ত (ঐশ্বর্য), তনু-তৃতাম্ জড়
দেহধারী জীবের প্রসঙ্গে অহম্ আমি, আশিষঃ অজ্ঞঃ—এই প্রকার আশীর্বাদের ফল
সম্বন্ধে ভালভাবে জেনে;
আয়ুঃ- দীর্ঘ আয়ু, শ্রিয়ম্ - জড় ঐশ্বর্য
বিভবম্ –প্রভাব এবংমহিমা, ঐন্দ্ৰিয়ম্ ——সব কিছুই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের
জন্য; আবিরিষ্ক্যাৎ
ব্রহ্মা থেকে শুরু করে (ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত), ন–না, ইচ্ছামি—আমি চাই তে আপনার দ্বারা
বিলুলিতান—বিনাশশীল, উরু-বিক্রমেণ
অত্যন্ত শক্তিশালী, কাল-আত্মনা—কালের প্রভুরূপে উপনয়—দয়া করে নিয়ে যান। মাম্
আমাকে নিজ ভৃত্য পার্শ্বম্—আপনার অত্যন্ত অনুগত ভক্তদের
সঙ্গে।
অনুবাদঃ হে ভগবান, এখন আমি ব্রহ্মা
থেকে শুরু করে পিপীলিকা পর্যন্ত সমস্ত জীবের জড় ঐশ্বর্য, যোগশক্তি,
দীর্ঘ আয়ু এবং অন্যান্য জড় সুখের পূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
মহাকাল রূপে আপনি এই সবই ধ্বংস করেন। তাই আমি সেগুলি চাই না। হে ভগবান, আমি কেবল আপনার কাছে অনুরোধ করি, দয়া করে আমাকে
শুদ্ধ ভক্তের সান্নিধ্য প্রদান করুন এবং ঐকান্তিক সেবকরূপে তাকে সেবা করতে দিন।
কুত্রাশিষঃ শ্ৰুতিসুখা মৃগতৃষ্ণিরূপাঃ
ক্বেদং কলেবরমশেষরুজাং
বিরোহঃ ।
নির্বিদ্যতে ন তু জনো যদপীতি
বিদ্বান্
কামানলং মধুলবৈঃ শময়ন্
দুৱাপৈঃ ৷৷ ২৫ ৷
কুত্র—কোথায়, আশিষঃ-আশীর্বাদ;
শ্রুতি-সুখাঃ- অতিমধুর, মৃগতৃষ্ণি রূপাঃ:
মরুভূমিতে মরীচিকার মতো ক্ব–কোথায়, ইদম্—এই কলেবরম্ শরীর, অশেষ—অন্তহীন, রুজাম্–রোগের, বিরোহঃ উদ্ভব স্থান,
নির্বিদ্যতে—তৃপ্ত হয়। ন–না, তৃ–কিন্তু, জন: জনসাধারণ, যত্ অপি—যদিও, ইতি—এই প্রকার, বিদ্বান্—তথাকথিত পণ্ডিত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক এবং
রাজনীতিবিদগণ, কাম অনলম্—কামাগ্নি, মধু-লৰৈঃ —মধুর (সুখের) বিন্দু, শময় –নিয়ন্ত্রণ করে: দুরাপৈঃ—যা লাভ করা অত্যন্ত কঠিন।
অনুবাদঃ এই জড় জগতে প্রতিটি জীবই
ভবিষ্যৎ সুখের কামনা করে,
যা ঠিক মরুভূমির মরীচিকার মতো। মরুভূমিতে জল কোথায়? ঠিক তেমনই এই জড় জগতে সুখ কোথায়? এই শরীরটির কি
মূল্য? এটি কেবল নানা প্রকার রোগের উদ্ভবস্থল। তথাকথিত দার্শনিক,
বৈজ্ঞানিক এবং রাজনীতিবিদেরা সেই কথা ভালভাবেই জানে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা অনিত্য সুখের আকাঙ্ক্ষা করে। সুখ লাভ করা অত্যন্ত
কঠিন, কিন্তু যেহেতু তারা তাদের ইন্দ্রিয় সংযমে অক্ষম,
তাই তারা জড় জগতের তথাকথিত সুখের পিছনে ধাবিত হয় এবং কখনই সঠিক
সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না।
ক্বাহং রজঃপ্রভব ঈশ তমোঽধিকেঽস্মিন্
জাতঃসুরেতরকুলেক্বতবানুকম্পা।
নব্রহ্মণোনতুভবস্যনবৈরমায়া
যন্মেঽপিতঃশিরসিপদ্মকরঃপ্রসাদঃ॥২৬॥
ক্ব–কোথায় অহম্ –আমি হই, রজঃপ্রভবঃ রজোগুণে
পূর্ণ একটি শরীরে জন্মগ্রহণ করে, ঈশ—হে ভগবান; তমঃ—তমোগুণ, অধিকে অতিক্রম করে
অশ্মিন্—এই জাতঃ—উৎপন্ন, সুর-ইতর কুলে
নাস্তিক বা আসুরিক পরিবারে (যা ভক্তদের থেকে নিম্ন স্তরের); ক্ব–কোথায় তব আপনার, অনুকম্পা–অহৈতুকী কৃপা, ন–না, ব্ৰহ্মণঃ–ব্রহ্মার ন–না, তু–কিন্তু ভবস্য শিবের, ন–না ৰৈ –এমন কি, রমায়াঃ—লক্ষ্মীদেবীর, যৎ—যা, মে–আমার, অর্পিতঃ–অর্পণ করেছেন: শিরসি—মস্তকে পদ্ম-করঃ–করকমল, প্রসাদঃ
অনুগ্রহসূচক।
অনুবাদঃ হে ভগবান, হে পরমেশ্বর,
নারকীয় তম ও রজোগুণাচ্ছন্ন অসুরকুল জাত আমি বা কোথায়? আর ব্রহ্মা, শিব অথবা লক্ষ্মীদেবীকেও যা কখনও প্রদান
করা হয়নি, আপনার সেই অহৈতুকী কৃপাই বা কোথায়? আপনি কখনও তাদের মস্তকে আপনার করকমল অর্পণ করেননি, কিন্তু
আমার ক্ষেত্রে আপনি তা করেছেন।
নৈষা পরাবরমতির্ভবতো ননু স্যা-
জ্জত্তোর্যথাত্মসুহৃদো
জগতস্তথাপি ৷
সংসেবয়া সুরতরোরিব তে প্রসাদঃ
সেবানুরূপমুদয়ো ন
পরাবরত্বম্ ৷৷ ২৭ ॥
ন—না; এষা—এই; পর অবর–উচ্চ অথবা নিচ; মতিঃ—এই প্রকার ভেদবুদ্ধি ভবতঃ—–আপনার; ননু বস্তুতপক্ষে,
স্যাৎ হতে পারে; জন্তোঃ- সাধারণ জীবে যথা—যেমন; আত্ম-সুহৃদঃ বন্ধুর;
জগতঃ সমগ্র জড় জগতের, তথাপিত সত্ত্বেও
(অন্তরঙ্গতা অথবা ভেদবুদ্ধির এই প্রকার প্রদর্শন); সংসেবয়া–ভত্তের সেব্য মাত্রা অনুসারে; সুরতরোঃ ইব—বৈকুণ্ঠলোকের কল্পবৃক্ষের
মতো (যা ভক্তের বাস অনুসারে ফল প্রদান করে); তে–আপনার, প্রসাদঃ –আশীর্বাদ; সেবা অনুরূপম্
ভগবানের প্রতি সম্পাদিত সেবা অনুসারে; উদয়ঃ–প্রকাশ, ন না; পর অবত্বম্ মহৎ এবং ক্ষুদ্রের ভেদ অনুসারে।
অনুবাদঃ হে ভগবান, আপনি সাধারণ জীবের
মতো শত্রু ও মিত্রের, এবং অনুকূল প্রতিকূলের মধ্যে ভেদভাব
দর্শন করেন না, কারণ আপনার মধ্যে উচ্চ এবং নি ধারণা নেই।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কল্পবৃক্ষ যেমন মহৎ এবং ক্ষুদ্রের মধ্যে পার্থ দর্শন না করে
জীবের বাসনা অনুসারে ফল প্রদান করে, তেমনই আপনি ভক্তে সেবার
মাত্রা অনুসারে তাকে আপনার আশীর্বাদ প্রদান করেন।
এবং জনং নিপতিতং প্রভবাহিকূপে
কামাভিকামমনু যঃ প্রপতন
প্ৰসঙ্গাত্ ।
কৃত্বাত্মসাৎ সুরর্ষিণা ভগবন্ গৃহীতঃ
সোঽহংকথংনুবিসৃজেতবভৃত্যসেবাম্ ॥২৮॥
এবম্—এইভাবে; জনম্ –সাধারণ মানুষ, নিপতিতম্—পতিত; প্রভব—জড় জগতের, অহি-কূপে—সর্পে পূর্ণ অন্ধকূপে
কাম-অভিকামম্ –ইন্দ্ৰিয়সুখ ভোগের বিষয়
বাসনা করে; অনু—অনুসরণ করে; যঃ—যে ব্যক্তি, প্রপতন – (এই অবস্থায়) পতিত
হয়ে; প্রসঙ্গাৎ—অসৎ সঙ্গের ফলে অথবা জড় বাসনার সংসর্গের ফলে; কৃত্বা আত্মসাৎ—আমাকে (নারদ মুনির মতো দিব্য
গুণাবলী প্রাপ্ত করতে বাধ্য করে; সুর -ঋষিণা—দেবর্ষি নারদের দ্বারা, ভগবন্—হে ভগবান; গৃহীতঃ—গ্রহণ করে, সঃ—সেই ব্যক্তি, অহম্ –আমি, কথম্ –কিভাবে, নু–বস্তুতপক্ষে, বিসৃজে—ত্যাগ করতে পারে; তব—আপনার; ভৃত্য-সেবাম্—আপনার শুদ্ধ ভক্তের সেবা।
অনুবাদঃ হে ভগবান, একের পর এক জড়
বাসনার সঙ্গ প্রভাবে আমি সাধারণ মানুষদের অনুসরণ করে সর্পপূর্ণ অন্ধকূপে পতিত
হয়েছি। আপনার সেবক নারদ মুনি কৃপা করে আমাকে তার শিষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন এবং
দিব্য স্থিতি প্রাপ্ত হওয়ার শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাই আমার সর্বপ্রথম কর্তব্য
তার সেবা করা। তাঁর সেবা আমি কি করে পরিত্যাগ করতে পারি?
মপ্রাণরক্ষণমনস্ত পিতৃবর্ধশ্চ
মন্যে স্বভৃত্যঋষিবাক্যমৃতং
বিধাতুম্ ॥
ৰগং প্রগৃহ্য যদবোচদসদ্ধিধিৎসু-
স্বামীশ্বরো মদপরোঽবতুকংহরামি॥২৯॥
মৎ-প্রাণ রক্ষণম্ –আমার জীবন রক্ষা করে, অনন্ত—হে অনন্ত, অন্তহীন চিন্ময়
গুণের উৎস পিতৃঃ–আমার পিতার বধঃ চ―এবং হত্যা করে; মন্যে—আমিমনে করি; স্বভৃত্য—আপনার ঐকান্তিক সেবক, ঋষি বাক্যম্ –দেবর্ষি নারদের বাকো, ঋতম্—সত্য; বিধাতুম্ –প্রমাণ করার জন্য; খড়্গগম্—খড়্গ; প্রগৃহ্য হস্তে ধারণ
করে, যৎ –যেহেতু; অবোচৎ –আমার পিতা বলেছিলেন; অসৎ বিধিৎসুঃ—অত্যন্ত অপবিত্রভাবে আচরণ করার
বাসনায়, ত্বাম্—আপনি; ঈশ্বরঃ—কোন পরম নিয়ন্তা মৎ-অপরঃ
আমি ভিন্ন অবতু রক্ষা করুক;
কম্–তোর মস্তক, হরামি—এখন আমি ছিন্ন করব।
অনুবাদঃ হে ভগবান, হে চিন্ময় গুণের
অন্তহীন উৎস, আপনি আমার পিতা হিরণ্যকশিপুকে বধ করে তাঁর খণ্ণ
থেকে আমাকে রক্ষা করেছেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে বলেছিলেন, “আমি এখন তোর দেহ থেকে তোর
মস্তক ছিন্ন করব। আমি ব্যতীত অন্য কোন ঈশ্বর যদি থাকে তা হলে সে তোকে রক্ষা করুক।”তাই আমি মনে করি যে, আপনার ভক্তের বাণীর
সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন এবং আমার পিতাকে বধ করেছেন। এই
ছাড়া অন্য কোন কারণ নেই।
একস্ত্বমেব জগদেতমমুষ্য যত্ ত্ব-
মাদ্যস্তয়োঃ পৃথগবস্যসি
মধ্যতশ্চ ৷
সৃষ্ট্বা গুণব্যতিকরং নিজমায়য়েদং
নানেব
তৈরবসিতস্তদনুপ্রবিষ্টঃ ॥ ৩০ ॥
একঃ—এক; ত্বম্ –আপনি; এব—কেবল; জগৎ-জড় জগৎ;
এতম্―এই; অমুষ্য—তার (সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের); যৎ–যেহেতু; ত্বম্―আপনি; আদি—শুরুতে; অন্তয়োঃ—অস্তে, পৃথক্ –পৃথকভাবে; অবস্যসি—– (কারণরূপে) বিরাজ
করেন; মধ্যতঃ চ—আদি এবং অস্তের মধ্যবর্তী অবস্থায় সৃষ্টা—সৃষ্টি করে; গুণ ব্যতিকরম্—জড়া প্রকৃতির তিন গুণের
বিকার; নিজ
মায়য়া—আপনার বহিরঙ্গা শক্তির
দ্বারা; ইদম্—এই; নানা ইব—বিবিধ প্রকার, তৈঃ—তাদের দ্বারা গুণের দ্বারা); অবসিতঃ—–প্রতীত; তৎ—তা; অনুপ্রবিষ্টঃ—প্রবেশ করে।
অনুবাদঃ হে ভগবান, আপনি নিজেকে সমগ্র
জগৎরূপে প্রকাশিত করেন, কারণ সৃষ্টির পূর্বে আপনি ছিলেন,
সৃষ্টির পরে আপনি থাকেন, এবং আদি ও অন্তের
মধ্যবর্তীঅবস্থায় আপনি পালন করেন। তা সবই প্রকৃতির তিনটি গুণের
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আপনার বহিরঙ্গা শক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়। অতএব
অন্তরে এবং বাইরে যা কিছু বিরাজ করে, তা সবই আপনি।
ত্বং বা ইদং সদসদীশ ভাংস্ততোঽন্যো
মায়া যদাত্মপরবুদ্ধিরিয়ং
হ্যপার্থা।
যদ্ যস্য জন্ম নিধনং স্থিতিরীক্ষণং চ
তদ্ বৈতদেব
বসুকালবদষ্টিতর্বোঃ ॥ ৩১ ॥
ত্বম্–আপনি, বা—অথবা, ইদম্–সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড, সৎ-অসৎ কার্য এবং
কারণ সমন্বিত (আপনি কারণ এবং আপনার শক্তি কার্য), ঈশ—হে পরমেশ্বর ভগবান, ভবান্—আপনি, ততঃ—ব্রহ্মাণ্ড থেকে অন্যঃ—পৃথকভাবে অবস্থিত (ভগবান
সৃষ্টি করেন, তবুও তিনি সৃষ্টি থেকে ভিন্ন থাকেন); মায়া—যে শক্তি ভিন্ন সৃষ্টিরূপে
প্রতীত হয়, যৎ—যার, আত্ম-পর-বুদ্ধিঃ—আপন এবং পরের ধারণা, ইয়ম্ —এই হি—বস্তুতপক্ষে, অপার্থা—অর্থহীন (আপনিই সব কিছু, এবং তাই ‘আমার’এবং ‘তোমার' এই ধারণার কোন অবকাশ
নেই), যৎ–যে বস্তু থেকে, যস্য—যাব; জন্ম–সৃষ্টি, নিধনম্ বিনাশ
স্থিতিঃ—পালন, ঈক্ষণম্ –প্রকাশ, চ–এবং তৎ—তা; বা—অথবা, এতৎ—এই; এব—নিশ্চিতভাবে বসুকালবৎ—পৃথিবীর গুণ এবং তার অতীত
পৃথিবীর সূক্ষ্ম তত্ত্ব (গন্ধ); অষ্টিতর্বোঃ—বীজ (কারণ) এবং বৃক্ষ (কারণের কার্য)।
অনুবাদঃ হে ভগবান, হে পরমেশ্বর,
সমগ্র জড় সৃষ্টির কারণ আপনি, এবং এই জড়
সৃষ্টি আপনারই শক্তির পরিণাম। যদিও সমগ্র জড় জগৎ আপনার থেকেই প্রকাশিত তবুও আপনি
তা থেকে ভিন্ন। 'আমার এবং তোমার ধারণা তা অবশ্যই মিথ্যা
মায়া, কারণ প্রতিটি বস্তুই আপনার থেকে উদ্ভূত হওয়ার ফলে
আপনার থেকে ভিন্ন নয়। বস্তুতপক্ষে জড় জগৎ আপনার থেকে অভিন্ন, এবং তার বিনাশও আপনারই দ্বারা সাধিত হয়। আপনার সঙ্গে আপনার সৃষ্টির
সম্পর্ক বীজ এবং বৃক্ষ, অথবা সূক্ষ্ম কারণ এবং স্কুল
প্রকাশের মতো।
নাস্যেদমাত্মনি জগদ বিলয়াসুমধ্যে
শেষেত্মনা নিজসুখানুভবো
নিরীহঃ ।
যোগেন মীলিতদ্গাত্মনিপীতনিদ্র-
স্তর্ষে স্থিতো ন তু তমো ন
গুণাংশ্চ যুক্ষে ॥৩২
নাস্য—নিক্ষেপ করে, ইদম্—এই আত্মনি—আপনার নিজের মধ্যে, জগৎ—আপনার সৃষ্ট জড় জগৎ, বিলয়-অসু-মধ্যে
কারণ-সমুদ্রে, যেখানে প্রত্যেক বস্তু সুরক্ষিত শক্তিরূপে
সংরক্ষিত থাকে, শেষে আপনি নিদ্রিতের মতো থাকেন, আত্মনা—আপনার দ্বারা নিজ আপনার
ব্যক্তিগত, সুখ অনুভবঃ—চিন্ময় আনন্দের অনুভূতি; নিরীহঃ—মনে হয় যেন কিছুই করেন না, যোগেন যোগশক্তির
দ্বারা, মীলিত দৃক্—চক্ষু যেন নিদ্রিত বলে মনে হয়, আত্ম- আপনার নিজের
প্রকাশের দ্বারা; নিপীত—নিরস্ত, নিদ্রঃ- যাঁর নিদ্রা
তুর্যে—দিব্য অবস্থায়, স্থিতঃ—নিজেকেস্থিত রেখে, ন–না: ডু–কিন্তু, তমঃ- জড় নিদ্রা,
ন না, গুণান-জড়া প্রকৃতির গুণ, চ–এবং যুদ্ধে আপনি নিজেকে
যুক্ত করেন।
অনুবাদঃ হে পরমেশ্বর ভগবান, আপনি প্রলয়ের পর
আপনার সৃজনী শক্তিকে আপনার মধ্যে রাখেন এবং তখন মনে হয় যেন আপনি অর্ধ-নিমীলিত
নেত্রে নিদ্রামগ্ন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনি সাধারণ মানুষের মতো নিদ্রা যান না,
কারণ আপনি সর্বদাই জড় সৃষ্টির অতীত। তুরীয় অবস্থায় আপনি চিন্ময়
আনন্দ অনুভব করেন। কারণোদকশায়ী বিষ্ণুরূপে আপনি এইভাবে জড়া প্রকৃতিকে স্পর্শ না
করে আপনার চিন্ময় স্থিতিতে অবস্থান করেন। আপনাকে নিদ্রিত বলে মনে হলেও, এই নিদ্রা অবিদ্যাজনিত নিদ্রা থেকে ভিন্ন।
তস্যৈব তে বপুরিদং নিজকালশক্ত্যা
সঞ্চোদিতপ্রকৃতিধর্মণ
আত্মগূঢ়ম্ ।
অন্তসানস্তশয়নাদ বিরমসমাধে-
নাভেরভূৎ
স্বকণিকাৰ্টৰন্মহাব্জম্ ৷৷ ৩৩ ৷৷
তস্য—সেই পরমেশ্বর ভগবানের এব–নিশ্চিতভাবে, তে আপনার বপুঃ
জগৎরূপ শরীর, ইদম্-এই ব্রহ্মাণ্ড, নিজ
কাল শক্ত্যা শক্তিশালী কালের দ্বারা; সঞ্চোদিত—ক্ষুব্ধ, প্রকৃতি-ধর্মণঃ–তার তিন গুণের দ্বারা আত্ম
গূঢ়ম্“আপনার মধ্যে সুপ্ত, অস্তসি—কারণার্ণব জলে অনন্ত শয়নাৎ
আপনারই অন্য আর একটি রূপ অনস্ত নামক শয্যা থেকে বিরমৎ-সমাধে:–সমাধি থেকে জেগে উঠে নাভেঃ—নাভি থেকে, অভূৎ আবির্ভূত
হয়েছে, স্ব-কণিকা বীজ থেকে, বটবৎ—বিশাল বটবৃক্ষ সদৃশ
মহা-অজম্- বিশ্বরূপী মহাপদ্ম (যুগপৎ উদ্ভূত হয়েছে)।
অনুবাদঃ এই বিশাল জড় জগৎ আপনারই
শরীর। আপনার কাল শক্তির দ্বারা প্রকৃতি ক্ষোভিত হয়, এবং তার ফলে প্রকৃতির তিনটি গুণ
প্রকাশিত হয়। আপনি তখন অনন্তশেষের শয্যা থেকে জেগে ওঠেন এবং আপনার নাভি থেকে একটি
চিন্ময় বীজ উৎপন্ন হয়। এই বীজ থেকে বিশাল ব্রহ্মাণ্ড প্রকাশকারী পদ্ম উদ্ভূত হয়,
ঠিক যেমন একটি ক্ষুদ্র বীজ থেকে এক বিশাল বটবৃক্ষের জন্ম হয়।
তৎসম্ভবঃ কবিরতোঽন্যদপশ্যমান-
স্ত্বাং বীজমাত্মনি ততং স
বহির্বিচিন্ত্য ।
নাবিন্দদব্দশতমপ্সু নিমজ্জমানো
জাতেঽঙ্কুরেকথমুহোপলভেতবীজম্৷৷৩৪
তৎসম্ভবঃ—যিনি সেই কমল থেকে উৎপন্ন
হয়েছেন, কবিঃ —যিনি সৃষ্টির সুক্ষ্ম কারণ
হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন (ব্রহ্মা); অতঃ—সেই (কমল) থেকে, অন্যৎ—অন্য কিছু; অপশ্যমানঃ—দেখতে অক্ষম ত্বাম্ –আপনি, বীজম্—সেই পদ্মের কারণ, আত্মনি—আপনাতে; ততম্ ব্যাপ্ত সঃ—তিনি (ব্রহ্মা); বহিঃ-বিচিন্ত্য—–বাহ্য বলে মনে করে; ন–—না; অবিন্দ – (আপনাকে) বুঝিয়েছিল,
অব্দশতম্ –দেবতাদের গণনায় এক শত বৎসর;* অপ্স-হলে, নিমজ্জমানঃ—মগ্ন থেকে; জাতে অঙ্কুরে—বীজ যখন অঙ্কুরিত হয়, কথম্ –কিভাবে; উহ –হে ভগবান, উপলভেত—দেখতে পায়; বীজম্—বীজকে।
অনুবাদঃ সেই মহাপদ্ম থেকে উৎপন্ন
ব্রহ্মা সেই পদ্ম ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পাননি। তাই, আপনাকে বাইরে অবস্থিত বলে মনে করে,
ব্রহ্মা সেই জলে নিমগ্ন হয়ে শতবর্ষব্যাপী সেই পদ্মের উৎসের অন্বেষণ
করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আপনাকে খুঁজে পাননি, কারণ
বীজ যখন অঙ্কুরিত হয়, তখন আর সেই বীজ দেখা যায় না।
স ত্বাত্মযোনিরতিবিস্মিত
আশ্রিতোহব্জং
কালেন তীব্রতপসা
পরিশুদ্ধভাবঃ ।
ত্বামাত্মনীশ ভুবি
গন্ধমিবাতিসূক্ষ্মং
ভূতেন্দ্রিয়াশয়ময়ে বিততং
দদর্শ ॥ ৩৫ ॥
সঃ–তিনি (ব্রহ্মা), তৃ—কিন্তু, আত্মযোনিঃ —যিনি মাতা ব্যতীত উৎপন্ন
হয়েছিলেন (সরাসরিভাবে পিতা বিষ্ণুর থেকে উৎপন্ন), অতি-বিস্মিতঃ (তাঁর জন্মের উৎস না
খুঁজে পেয়ে) অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন আশ্রিতঃ অবস্থিত, অজম্ –পদ্ম, কালেন—যথাসময়ে তীব্র তপসা কঠোর
তপস্যার দ্বারা পরিশুদ্ধ ভাবঃ—সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ হয়ে; ত্বাম্—আপনি; আত্মনি—তাঁর শরীরে এবং অস্তিত্বে, ঈশ হে ভগবান;
ভুবি—ভূমিতে, গন্ধম্—গন্ধ; ইব—সদৃশ, অতি-সূক্ষ্মম্ –অত্যন্ত সূক্ষ্ম; ভূত-ইন্দ্রিয়—উপাদান এবং ইন্দ্রিয়ের
দ্বারা রচিত; আশয় ময়ে—এবং যা বাসনায় (মনে) পূর্ণ, বিততম্—বিস্তৃত; দদর্শ—দেখেছিলেন।
অনুবাদঃ সেই আত্মযোনি ব্রহ্মা
অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে সেই পদ্মকে আশ্রয় করে বহু শত বৎসর কঠোর তপস্যা করার ফলে
পবিত্র হয়ে সর্বকারণের পরম কারণস্বরূপ ভগবানকে দর্শন করেছিলেন। পৃথিবীতে যেমন গন্ধ
অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ব্যাপ্ত থাকে, তেমনই তাঁর নিজের শরীরে এবং ইন্দ্রিয়ে তিনি
ভগবানকে ব্যাপ্ত দেখেছিলেন।
এবংসহস্রবদনাঘিশিরঃকরোরু-
নাসাদ্যকর্ণনয়নাভরণায়ুধাঢ্যম্
।
মায়াময়ং সদুপলক্ষিতসন্নিবেশং
দৃষ্ট্বা মহাপুরুষমাপ মুদং
বিরিঞ্চঃ ৷৷ ৩৬ ৷৷
এবম্—এইভাবে; সহস্র হাজার হাজার;
বদন—মুখ, অঙ্কি–পা; শিরঃ —মস্তক; কর–হাত; উরু–উরু; নাসাদ্য—নাক ইত্যাদি; কর্ণ–কান; নয়ন—চক্ষু; আভরণ—বিবিধ অলঙ্কার, আয়ুধ—বিবিধ অস্ত্র, আঢ্যম্—সমন্বিত; মায়া-ময়ম্—অনন্ত শক্তির দ্বারা
প্রদর্শিত; সৎ-উপলক্ষিত–বিভিন্ন লক্ষণের দ্বারা প্রকাশিত হয়ে; সন্নিবেশম্—একত্রে সমাবেশ; দৃষ্ট্বা–দর্শন করে মহা-পুরুষম্—পরমেশ্বর ভগবানকে; আপ—লাভ করেছিলেন; মুদম্—দিব্য আনন্দ, বিরিঞ্চঃ—ব্রহ্মা।
অনুবাদঃ ব্রহ্মা তখন সহস্র সহস্র বদন, চরণ, মস্তক, হস্ত, ঊরু, নাসিকা, কর্ণ ও নয়ন সমন্বিত আপনাকে দেখেছিলেন। আপনি
সুন্দর অলঙ্কার এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিলেন। পাতাললোকে বিস্তৃত পদ সমন্বিত,
চিন্ময় লক্ষণযুক্ত আপনার বিষ্ণুরূপ দর্শন করে ব্রহ্মা দিব্য আনন্দ
লাভ করেছিলেন।
তস্মৈ ভবান হয়শিরস্তনুবং হি বিভ্রদ্
বেদদ্রুহাবতিবলৌ
মধুকৈটভাখ্যৌ ৷
হত্বানয়চ্ছুতিগণাংশ্চ রজস্তমশ্চ
সত্ত্বং তব প্রিয়তমাং
তনুমামনন্তি ৷৷ ৩৭ ৷৷
তস্মৈ—ব্রহ্মাকে, ভবানন্—আপনি; হয়শিরঃ—হয়গ্রীব, তনুবম্—অবতার হি—বস্তুতপক্ষে, বিভ্রৎ—ধারণ করে; বেদদ্রুহৌ—বৈদিক সিদ্ধান্তের বিরোধী
দুই অসুরকে; অতি বলৌ--অত্যন্ত শক্তিশালী; মধু-কৈটভ-আখৌ —মধু এবং কৈটভ নামক হত্বা–বধ করে, অনয়ৎ—–উদ্ধার করেছিলেন; শ্রুতি-গণানন্—সমস্ত বেদ (সাম, যজুঃ, ঋক্ এবং অথব); চ–এবং, রজঃ তমঃ চ–রজ এবং তমোগুণের প্রতীক, সত্ত্বম্—শুদ্ধ সত্ত্ব তব—আপনার প্রিয় তমাম্–সর্বাধিক প্রিয়; তনুম্― (হয়গ্রীব) রূপ;
আমনন্তি—তাঁরা সম্মান করেন।
অনুবাদঃ হে ভগবান, আপনি হয়গ্রীবরূপে
আবির্ভূত হয়ে রজ এবং তমোগুণের প্রতীক মধু এবং কৈটভ নামক অসুরদের সংহার করে
ব্রহ্মাকে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। সেই কারণে সমস্ত ঋষিরা আপনার রূপকে
জড়াতীত শুদ্ধ সত্ত্বময় বলে বর্ণনা করেন।
ইত্থং নৃতির্যগৃষিদেবঝষাবতারৈ-
লোকান্ বিভাবয়সি হংসি জগৎপ্রতীপান্
।
ধর্মং মহাপুরুষ পাসি যুগানুবৃত্তং
ছন্নঃ কলৌ যদভবস্ত্রিযুগোঽথসত্বম্৷৷৩৮॥
ইথম্—–এইভাবে; নৃ—নররূপে (শ্রীকৃষ্ণ এবং
শ্রীরামচন্দ্ররূপে); তির্যক্—পশুরূপে (যেমন রাহদেব); ঋষি –ঋষিরূপে (পরশুরাম); দেব–দেবতারূপে; ঝষ জলচর রূপে (যেমন
মৎস্য এবং কূর্ম); অবতারৈঃ–এই প্রকার বিভিন্ন অবতারের
দ্বারা; লোকান্—সমস্ত গ্রহলোকের, বিভাবয়সি রক্ষা
করেন; হংসি—আপনি (কখনওকখনও) হত্যা করেন; জগৎ প্রতীপান্—যারা এই জগতে প্রতিকূলতার
সৃষ্টি করে; ধর্মম্—ধর্ম; মহা-পুরুষ—হে মহাপুরুষ পাসি—আপনি রক্ষা করেন; যুগ অনুবৃত্তম্—বিভিন্ন যুগ অনুসারে, ছন:—প্রচ্ছন্ন, কলৌ –কলিযুগে; যৎ—যেহেতু, অভবঃ হয়েছে (এবং
ভবিষ্যতে হবে); ত্রিযুগঃ —ত্রিযুগ নামক, অথ—অতএব, সঃ—সেই ব্যক্তি; ত্বম্—আপনি।
অনুবাদঃ হে ভগবান্, এইভাবে আপনি নর,
পশু, ঋষি, দেবতা,
মৎস্য অথবা কূর্মরূপে অবতরণ করে সমগ্র জগৎ পালন করেন এবং অসুরদের
সংহার করেন। হে ভগবান, আপনি যুগ অনুসারে ধর্মকে রক্ষা করেন।
কিন্তু কলিযুগে আপনি আপনার ভগবত্তা প্রকাশ করেন না, তাই
আপনাকে ত্রিযুগ বলা হয়।
নৈতন্মনস্তব কথাসু বিকুণ্ঠনাথ
সম্প্রীয়তে দুরিতদুষ্টমসাধু তীব্রম্
।
কামাতুরং হর্ষশোকভয়ৈষণার্তং
তস্মিন্ কথং তব গতিং বিমৃশামি দীনঃ৷৷
৩৯ ৷৷
ন—অবশ্যই নয়; এতৎ –এই; মনঃ—–মন; তব—আপনার; কথাসু—আপনার দিব্য কথায়, বিকুণ্ঠনাথ—হে বৈকুণ্ঠনাথ; সম্প্ৰীয়তে শান্ত
হয় বা আগ্রহশীল হয়; দূরিত–পাপকর্মের দ্বারা দুষ্টম্
কলুষিত, অসাধু
অসৎ; তীব্রম্ –বশীভূত করা অত্যন্ত কঠিন; কাম-আতুরম্—সর্বদা কামবাসনায় পূর্ণ; হর্ষ-শোক কখনও
হর্ষের দ্বারা এবং কখনও শোকের দ্বারা, ভয় এবং কখনও ভয়ের
দ্বারা; এষণা এবং বাসনার দ্বারা; আতম্—পীড়িত; তস্মিন্—সেই মানসিক অবস্থায়, কথম্ —কিভাবে; তব—আপনার; গতিম্–চিন্ময় কার্যকলাপ; বিমৃশামি–আমি বিবেচনা করব এবং বুঝতে
চেষ্টা করব; দীনঃ অত্যন্ত পতিত এবং দরিদ্র।
অনুবাদঃ হে বৈকুণ্ঠনাথ, আমার পাপপূর্ণ
কামাতুর মন হর্ষ, শোক, ভয় এবং ধন
লাভের বাসনায় পূর্ণ। তার ফলে তা অত্যন্ত কলুষিত এবং আপনার কথায় প্রীতি লাভ করে
না। সুতরাং দীন এবং পতিত আমি কিভাবে আপনার তত্ত্ব আলোচনা করতে সক্ষম হব?
জিহ্বৈকতোঽচ্যুতবিকৰ্ষতিমাবিতৃপ্তা
শিশ্লোঽন্যতত্ত্বগুদরংশ্রবণংকুতশ্চিৎ ।
ঘ্রাণোঽন্যতশ্চপলদৃক্ক্বচকর্মশক্তি-
বহঃ সপত্ন্য ইব গেহপতিং
লুনস্তি ৷৷ ৪০
জিহ্বা—জিহ্বা একতঃ–একদিকে; অচ্যুত—হে অচ্যুত ভগবান; বিকৰ্ষতি—আকর্ষণ করে; মা—আমাকে; অবিতৃপ্তা—তৃপ্ত না হয়ে, শিশ্নঃ—উপস্থ; অন্যতঃ —অন্যদিকে; ত্বক্—ত্বক (কোমল বস্তু স্পর্শ
করার জন্য); উদরম্–উদর (বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের
জন্য); শ্রবণম্
–কর্ণ (মধুর সঙ্গীত শ্রবণ
করার জন্য); কুতশ্চিৎ –অন্য কোন দিকে; ঘ্রাণঃ–নাক (ঘ্রাণ গ্রহণের জন্য); অন্যতঃ–অন্য আরেক দিকে; চপলদৃক্–চঞ্চল চক্ষু; ক্ব চ—কোথাও; কর্মশক্তিঃ—সক্রিয় ইন্দ্রিয়; বহাঃ—বহু; সপত্ন্যঃ—সতীন; ইব—সদৃশ, গেহ-পতিম্ –গৃহস্থ লুনন্তি —বিনাশ করে।
অনুবাদঃ হে অচ্যুত, আমার অবস্থা বহু
সপত্নীর স্বামীর মতো, যারা তাকে তাদের নিজেদের দিকে আকৃষ্ট
করার চেষ্টা করে। জিহ্বা সুস্বাদু আহারের প্রতি, উপস্থ
সুন্দরী রমণীর প্রতি, ত্বক কোমল বস্তুর প্রতি, উদর ভোজনের প্রতি, এবং কর্ণ গ্রাম্য সঙ্গীতের প্রতি,
নাক ঘ্রাণের প্রতি, চঞ্চল দৃষ্টি ইন্দ্রিয়
তৃপ্তিদায়ক সুন্দর দৃশ্যের প্রতি, এবং কর্মেন্দ্রিয়
বিভিন্ন কর্মের প্রতি আমাকে আকর্ষণ করছে। এইভাবে বিভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হয়ে আমি
বিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছি।
এবং স্বকর্মপতিতং ভববৈতরণ্যা-
মন্যোন্যজন্মমরণাশনভীতভীতম্
॥
পশ্যঞ্জনং স্বপরবিগ্রহবৈরমৈত্রং
হস্তেতি পারচর পীপৃহি
মূঢ়মদ্য ৷৷ ৪১ ৷৷
এবম্—এইভাবে; স্ব-কর্ম-পতিতম্—স্বীয় কার্যকলাপের ফলে
অধঃপতিত, ভব—অজ্ঞান জগৎ (জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধি), বৈতরণ্যাম–বৈতরণী নদীতে (যা যমালয়ের
দ্বারে প্রবাহিত হয়); অন্যঃ অন্য একের পর এক, জন্ম-জন্ম, মরণ—মৃত্যু; আশন—বিভিন্ন প্রকার আহার্য, ভীত-ভীতম্―অত্যন্ত ভীত হয়ে; পশ্যন্—দর্শন করে; জনম্ জীব, স্ব—নিজের; পর অন্যের বিগ্রহ—শরীরে, বৈর মৈত্রম্ শত্রুতা
এবং মিত্রতা, হস্ত—হায়; ইতি—এইভাবে, পারচর –মৃত্যুর নদীর অপর পারে স্থিত
আপনি; পীপৃহি—দয়া করে আমাদের এই ভয়ঙ্কর
পরিস্থিতি থেকে) রক্ষা করুন; মূঢ়ম্ আমরা সকলে আধ্যাত্মিক জ্ঞানরহিত অত্যন্ত মূর্খ,
অদ্য—আজ (যেহেতু আপনি স্বয়ং
এখানে উপস্থিত হয়েছেন)।
অনুবাদঃ হে ভগবান, আপনি সর্বদাই
মৃত্যুনদীর অপর পারে চিন্ময়ভাবে অবস্থিত, কিন্তু আমরা
আমাদের পাপকর্মের ফলে সেই নদীর এই পারে দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা
এই নদীতে পতিত হয়ে বার বার জন্ম-মৃত্যুর যন্ত্রণা ভোগ করছি এবং অত্যন্ত ঘৃণ্য
বস্তুসমূহ আহার করছি। দয়া করে আপনি আমাদেরপ্রতি দৃষ্টিপাত করুন—কেবল আমার প্রতিই নয়, অন্য যারা কষ্টভোগ
করছে তাদের প্রতিও—এবং আপনার অহৈতুকী কৃপা ও
অনুকম্পার প্রভাবে আমাদের উদ্ধার করুন এবং পালন করুন।
কো ন্বত্র তেঽখিলগুরোভগবন্প্রয়াস
উত্তারণেঽস্যভবসম্ভবলোপহেতোঃ।
মূঢ়েষুবৈমহদনুগ্রহআর্দ্রবন্ধো
কিং তেন তে
প্রিয়জনাননুসেবতাং নঃ॥৪২৷
কঃ—তা কি; নু—বস্তুতপক্ষে, অত্র—এই বিষয়ে তে—আপনার; অখিল গুরো - হে
সমগ্র জগতের পরম গুরু; ভগবন্ –হে ভগবান; প্রয়াসঃ—প্রচেষ্টা; উত্তারণে
বদ্ধ জীবদের উদ্ধারের জন্য; অস্য–এর; ভব-সম্ভব—সৃষ্টি এবং পালনের; লোপ—এবং প্রলয়ের; হেতোঃ—কারণের; মূঢ়েষু—এই জড় জগতের দুর্দশাগ্রস্ত
মূর্খ
মানুষেরা; বৈ—বস্তুতপক্ষে; মহৎ-অনুগ্রহঃ—ভগবানের কৃপা; আর্দ্র বন্ধোঃ—হে আৰ্দ্ৰজীবদের বন্ধু; কিম্—কি অসুবিধা, তেন—তা দ্বারা; তে আপনার
প্রিয়জনান্
প্রিয়জনদের (ভক্তদের); অনুসেবতাম্—যাঁরা সর্বদা সেবাপরায়ণ; নঃ—আমাদেরমতো (যারা এইভাবে
যুক্ত)।
অনুবাদঃ হে পরমেশ্বর ভগবান, হে সমগ্র জগতের আদি
গুরু, আপনি সারা জগতের সমস্ত কার্যের পরিচালক, অতএব আপনার পক্ষে আপনার সেবায় যুক্ত অধঃপতিত জীবদের উদ্ধার করা এমন কি
পরিশ্রম? আপনি সমস্ত আর্তদের বন্ধু, এবং
মহতের কর্তব্য হচ্ছে মূর্খদের প্রতি কৃপা প্রদর্শন করা। তাই আমি মনে করি যে,
আপনার সেবায় যুক্ত আমাদের মতো ব্যক্তিদের প্রতি আপনি আপনার অহৈতুকী
কৃপা প্রদর্শন করবেন।
নৈবোদ্বিজে পর দুরত্যয়বৈতরণ্যা
স্ত্বদ্বীর্যগায়নমহামৃতমগ্নচিত্তঃ
।
শোচে ততো বিমুখচেতস ইন্দ্রিয়ার্থ-
মায়াসুখায় ভরমুদ্বহতো
বিমূঢ়ান্ ৷৷ ৪৩ ৷৷
ন—না; এব—নিশ্চিতভাবে; উদ্বিজে–আমি উদ্বিগ্ন অথবা ভীত; পর—হে পরমেশ্বর ভগবান; দুরত্যয়–দুরতিক্রম্য; বৈতরণ্যাঃ—বৈতরণী নদীর; ত্বৎ-বীর্য –আপনার মহিমার এবং
কার্যকলাপের; গায়ন—কীর্তন বা বিতরণ করার ফলে; মহা অমৃত—চিন্ময় আনন্দামৃতের মহা
সমুদ্রে; মগ্ন-চিত্তঃ—যার চেতনা মগ্ন; শোচে—–আমি শোক করি; ততঃ–তা থেকে বিমুখ-চেতসঃ
কৃষ্ণভক্তি বিহীন মূঢ় ব্যক্তিরা; ইন্দ্ৰিয়-অর্থ—ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি সাধনে; মায়া-সুখায়–অনিত্য জড় সুখের জন্য; ভরম্—অনর্থক বোঝা বা দায়িত্ব
(পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদির প্রতিপালনের জন্য বিশাল
আয়োজন); উদ্বহতঃ–যারা বহন করছে (সেই আয়োজনের জন্য বিশাল পরিকল্পনা
করে); বিমূঢ়ান্—যদিও তারা মূর্খ এবং
দুষ্কৃতকারী ছাড়া আর কিছু নয় (তবুও আমি তাদের জন্য চিন্তা করি)।
অনুবাদঃ হে সর্বোত্তম, আপনার গুণগান এবং
কার্যকলাপের চিন্তায় সম্পূর্ণরূপে মগ্ন থাকার ফলে আমি সংসার ভয়ে ভীত নই। আমার
একমাত্র চিন্তা কেবল সেই সমস্ত মূর্খ এবং দুষ্কৃতকারীদের জন্য, যারা জড় সুখ ভোগের জন্য এবং তাদের পরিবার, সমাজ ও
রাষ্ট্রের প্রতিপালনের জন্য বিশাল পরিকল্পনা করে।
প্রায়েণ দেব মুনয়ঃ স্ববিমুক্তিকামা
মৌনং চরস্তি বিজনে ন
পরার্থনিষ্ঠাঃ ।
নৈতান্ বিহায় কৃপণান্ বিমুমুক্ষ একো
নান্যং ত্বদস্য শরণং ভ্রমতোঽনুপশ্যে॥৪৪॥
প্রায়েণ–সাধারণত, প্রায় সকল ক্ষেত্রে,
দেব–হে ভগবান, মুনয়ঃ —মহান ঋষিগণ; স্ব—নিজের; বিমুক্তি কামাঃ জড় জগৎ
থেকে মুক্তি লাভের অভিলাষী; মৌনম্—নীরবে; চরন্তি–বিচরণ করেন (হিমালয়ের
অরণ্যের মতো স্থানে, যেখানে বিষয়ী ব্যক্তিদের কার্যকলাপের কোন সংস্পর্শ নেই); বিজনে—নির্জন স্থানে, ন–না; পর অর্থ-নিষ্ঠাঃ—–অন্যদের কৃষ্ণভক্তি প্রদান
করার জন্য যারা কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রচার কার্যে নিষ্ঠাপরায়ণ; ন–না, এতান—এই সমস্ত বিহায়—পরিত্যাগ করে, কৃপণান্ মূর্খ এবং
দুষ্কৃতকারীরা (যারা মানব জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত না হয়ে জড় জাগতিক
কার্যকলাপে যুক্ত); বিমুমুক্ষে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত
হয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার বাসনা; একঃ—একা; ন–না অন্যম্ –অন্য; ত্ব–কেবল আপনারই জন্য অস্য এর; শরণম্ আশ্রয়,
ভ্রমতঃ–ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ভ্রমণশীল জীবের অনুপশ্যে আমি দেখি।
অনুবাদঃ হে ভগবান নৃসিংহদেব, মুনিরা কেবল তাদের
নিজেদের মুক্তির জন্য আগ্রহী। তারা বড় বড় নগর এবং শহর পরিত্যাগপূর্বক মৌন ব্রত
অবলম্বন করে ধ্যান করার জন্য হিমালয়ে অথবা অরণ্যে গমন করেন। তারা অন্যদের
উদ্ধারের জন্য আগ্রহী নন। কিন্তু আমি, এই সমস্ত মূর্খদের
ফেলে রেখে নিজের মুক্তি কামনা করি না। আমি জানি যে কৃষ্ণভক্তি ব্যতীত, এবং আপনার শ্রীপাদপদ্মের শরণ গ্রহণ ব্যতীত কেউই কখনও সুখী হতে পারে না। তাই
আমি তাদের আপনার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয়ে নিয়ে আসতে চাই।
যন্মৈথুনাদি গৃহমেধিসুখং হি তুচ্ছং
কণ্ডুয়নেন করয়োরিব
দুঃখদুঃখম্ ৷
তৃপ্যন্তি নেহ কৃপণা বহুদুঃখভাজঃ
কণ্ডুতিবন্মনসিজং বিষহেত
ধীরঃ ॥ ৪৫ ॥
যৎ—যা (ইন্দ্রিয়তৃপ্তির নিমিত্ত), মৈথুনাদি—(গৃহে অথবা বাইরে) যৌন
বিষয়ের আলোচনা, যৌন বিষয়ক পুস্তকাদি পাঠ অথবা স্ত্রীসম্ভোগ;
গৃহমেধি-সুখম্—পরিবার, সমাজ, বন্ধুত্ব
ইত্যাদির আসক্তির ভিত্তিতে সর্বপ্রকার জড় সুখ; হি—বস্তুতপক্ষে; তুচ্ছম্—তুচ্ছ: কয়নেন চুলকানি, করয়োঃ—দুই হাতের; ইব—সদৃশ; দুঃখ দুঃখম্—–(এই প্রকার চুলকানির
ফলে) বিভিন্ন প্রকার দুঃখ, তৃপ্যন্তি—তৃপ্ত হয়; ন—কখনই না; 'ইহ—জড় ইন্দ্রিয়সুখ ভোগে, কৃপণাঃ–মূর্খ ব্যক্তিরা; বহু দুঃখ-ভাজঃ—বিভিন্ন প্রকার জড় দুঃখ ভোগ
করে; কতিবৎ—এই প্রকার চুলকানি থেকে যদি
শিখতে পারে; মনসিজম্—যা কেবল মানসিক কল্পনা
(প্রকৃতপক্ষে তাতে কোন সুখ নেই); বিষহেত—এবং (এই প্রকার চুলকানি) সহ্য করে; ধীরঃ—তিনি তখন অত্যন্ত পূর্ণ এবং
ধীর হতে পারেন।
অনুবাদঃ চুলকানির উপশমের জন্য দুই
হাতের ঘর্ষণের সঙ্গে মৈথুনের তুলনা করা হয়। গৃহমেধী বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানরহিত
তথাকথিত গৃহস্থেরা মনে করে যে, এই চুলকানিটিই সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ, কিন্তু
প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে সমস্ত দুঃখের উৎস। কৃপণ অথবা মূর্খেরা, যারা ব্রাহ্মণের ঠিক বিপরীত, বার বার ইন্দ্রিয়সুখ
ভোগের ফলেও তারা কখনও তৃপ্ত হয় না। কিন্তু যাঁরা ধীর, তারা
এই চুলকানি সহ্য করেন এবং তার ফলে তাদের মূঢ়দের মতো দুঃখভোগ করতে হয় না।
মৌনব্রতশ্ৰুততপোঽধ্যয়নস্বধর্ম-
ব্যাখ্যারহোজপসমাধয়
আপবর্গ্যাঃ ।
প্রায়ঃ পরং পুরুষ তে
ত্বজিতেন্দ্রিয়াণাং
বার্তা ভবস্তুত ন বাত্র তু
দাম্ভিকানাম্ ৷৪৬৷
মৌন—মৌন; ব্রত–ব্রত, শ্রুত—বৈদিক জ্ঞান; তপঃ—তপশ্চর্যা অধ্যয়ন—শাস্ত্র অধ্যয়ন; স্ব-ধর্ম-বর্ণাশ্রম-ধর্ম
আচরণ; ব্যাখ্যা —শাস্ত্র ব্যাখ্যা রহঃ —নির্জন স্থানে বাস; জপ—মন্ত্র উচ্চারণ; সমাধয়ঃ—সমাধিস্থ হওয়া; আপবর্গ্যাঃ—মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার
এই দশটি কার্য; প্রায়: সাধারণত পরম্—একমাত্র উপায়: পুরুষ—হে ভগবান; তে–সেই সব, তু–কিন্তু, অজিত ইন্দ্রিয়াণাম্—যারা তাদের ইন্দ্রিয় সংযত
করতে পারে না তাদের বার্তাঃ-জীবিকা; ভবন্তি—হয়; উত—বলা হয়; ন–না; বা—অথবা, অত্র—এই সম্পর্কে, তু—কিন্তু, দাম্ভিকানাম্—দাস্তিক ব্যক্তিদের।
অনুবাদঃ হে পরমেশ্বর ভগবান, মুক্তির মার্গে দশটি
উপায়—মৌন, ব্রত, বৈদিক জ্ঞান আহরণ, তপস্যা, বৈদিক
শাস্ত্র অধ্যয়ন, বর্ণাশ্রম ধর্ম আচরণ, ধর্ম শাস্ত্রের ব্যাখ্যা, নির্জন স্থানে বাস,
মন্ত্র জপ এবং সমাধি। মুক্তির এই সমস্ত উপায়গুলি অজিতেন্দ্রিয়
ব্যক্তিদের পেশাদারি অভ্যাস এবং জীবিকা। যেহেতু এই ধরনের মানুষেরা অত্যন্ত দাস্তিক,
তাই এই উপায়গুলি সফল নাও হতে পারে।
রূপে ইমে সদসতী তব বেদসৃষ্টে
বীজাঙ্কুরাবিব ন
চান্যদরূপকস্য ।
যুক্তাঃ সমক্ষমুভয়ত্র বিচক্ষন্তে
ত্বাং
যোগেন বহ্নিমিব দারুষু
নান্যতঃ স্যাৎ ॥৪৭॥
রূপে রূপে, ইমে—এই দুই সৎ-অসতী কার্য এবং
কারণ; তব—আপনার, বেদসৃষ্টে—বেদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; বীজ অঙ্কুরৌ–বীজ এবং অঙ্কুর; ইব—সদৃশ;
নকখনই না; চ–ও; অন্যৎ অন্য কোন
অরূপকস্য জড় রূপবিহীন আপনার;যুক্তাঃ—যারা আপনার প্রেমময়ী সেবায়
যুক্ত; সমক্ষম্—চক্ষুর সম্মুখে; উভয়ত্র—দুইভাবেই (আধ্যাত্মিক এবং
ভৌতিক); বিচক্ষন্তে—প্রকৃতপক্ষে দেখতে পারে;ত্বাম্—আপনি; যোগেন—কেবল ভগবদ্ভুক্তির দ্বারা
বহ্নিম্ অগ্নি; ইব—সদৃশ;দারুষ—কাঠে; ন–না; অন্যতঃ–অন্য কোন উপায়ে; স্যাৎ—সম্ভব।
অনুবাদঃ প্রামাণিক বৈদিক জ্ঞানের
দ্বারা দেখা যায় যে, জড় জগতে কার্য এবং কারণের রূপ ভগবানেরই রূপ, কারণ
জড় জগৎ তারই শক্তি। কার্য এবং কারণ উভয়ই
ভগবানের শক্তি ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তাই, হে
ভগবান, জ্ঞানী ব্যক্তি যেমন কার্য এবং কারণের বিচার করে
দেখতে পান কিভাবে কাঠের মধ্যে অগ্নি ব্যাপ্ত, তেমনই ভগবানের
প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত ভক্তও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন যে, আপনিই
কার্য এবং কারণ।
ত্বং
বায়ুরগ্লিরবনির্বিয়দম্বুমাত্রাঃ
প্রাণেন্দ্রিয়াণি হৃদয়ং
চিদনুগ্রহশ্চ ।
সর্বং ত্বমেব সগুণো বিগুণশ্চ ভূমন্
নান্যত্ ত্বদস্ত্যপি মনোবচসা
নিরুক্তম্ ॥ ৪৮ ॥
ত্বম্ —আপনি (হন), বায়ুঃ —বায়ু; অগ্নিঃ —অগ্নি; অবনিঃ—পৃথিবী; বিয়ৎ –আকাশ অম্বু—জল; মাত্রাঃ—ইন্দ্রিয়ের বিষয়; প্রাণ—প্রাণবায়ু; ইন্দ্রিয়াণি—ইন্দ্রিয়সমূহ: হৃদয়ম্—মন; চিৎ–চেতনা; অনুগ্রহঃ চ–অহষ্কার বা দেবতাগণ, সর্বম্ —সব কিছুত্বম–আপনি; এব—কেবল, স-গুণঃ–ত্রিগুণাত্মিকা জড়া প্রকৃতি, বিগুণঃ–জড়া প্রকৃতির অতীত
চিৎ-স্ফুলিঙ্গ এবং পরমাত্মা; চ–এবং ভূমন্ –হে ভগবান; ন—না; অন্যত্— অন্য; ত্বৎ আপনার থেকে অস্তি—আছে, অপি –যদিও; মনঃ বচসা—মন এবং বাণীর দ্বারা
নিরুক্তম্—সব কিছু প্রকাশিত।
অনুবাদঃ হে পরমেশ্বর ভগবান, আপনি বায়ু, পৃথিবী, আণ্ডন, আকাশ, জল, তন্মাত্র প্রাণবায়ু, পঞ্চেন্দ্রিয়,
মন, চেতনা এবং অহঙ্কার। বস্তুতপক্ষে, সূক্ষ্ম এবং স্থূল, সব কিছুই আপনি। মন এবং বাক্যের
দ্বারা প্রকাশিত কোন বস্তুই আপনার থেকে ভিন্ন নয়।
নৈতে গুণা ন গুণিনো মহদাদয়ো যে
সর্বে মনঃপ্রভৃতয়ঃ
সহদেবমর্ত্যাঃ ।
আদ্যস্তবস্তু উরুগায় বিদন্তি হি
ত্বা-
মেবং বিমশ্য সুধিয়ো
বিরমন্তি শব্দাৎ ॥ ৪৯ ॥
ন—নয়; এতে—এই সমস্ত গুণা:—–জড়া প্রকৃতির তিন গুণ; ন–না; গুণিনঃ—জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের
প্রধান দেবতা (যথা, রজোগুণের অধিষ্ঠাত্ব দেবতাব্রহ্মা, এবং তমোগুণের
অধিষ্ঠাত্ব দেবতা শিব); মহৎ-আদয়ঃ—পঞ্চ মহাভূত, ইন্দ্রিয় এবং
তন্মাত্র যে—যা সর্বে—সমস্ত মনঃ—মন; প্রভৃতয়ঃ —ইত্যাদি; সহদেব মর্ত্যাঃ—স্বর্গের দেবতা এবং
মর্ত্যলোকের মানুষেরা; আদি-অন্ত-বন্ত:—যাদের আদি এবং অস্ত রয়েছে, উরুগায়—মহাত্মাদের দ্বারা বন্দিত
পরমেশ্বর ভগবান; বিদন্তি—হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন; হি—বস্তুতপক্ষে; ত্বাম্—আপনি; এবম্—এইভাবে: বিমৃশ্য—বিবেচনা করে; সুধিয়ঃ—সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তিরা; বিরমন্তি—বিরত হন; শব্দাৎ—বেদ অধ্যয়ন এবং বেদের মর্ম
উপলব্ধি করার থেকে।
অনুবাদঃ জড়া প্রকৃতির তিন গুণ
(সত্ত্ব, রজ এবং তমোগুণ), এই তিন গুণের অধিষ্ঠাত্ব দেবতাগণ,
পঞ্চ স্থূল তত্ত্ব, মন, দেবতা,
মানুষ, কেউই আপনাকে জানতে পাে না, কারণ তারা সকলেই জন্ম-মৃত্যুর অধীন। সেই কথা বিবেচনা করে, প্রকৃত জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ভগবদ্ভুক্তির পন্থা অবলম্বন করেন। এই প্রকার
জ্ঞানবান ব্যক্তিরা বেদ অধ্যয়ন থেকে বিরত হয়ে ভগবদ্ভক্তিতে যুক্ত হন।
তৎ তেঽর্হত্তমনমঃস্তুতিকর্মপূজাঃ
কর্মস্মৃতিশ্চরণয়োঃশ্রবণংকথায়াম্॥
সংসেবয়াত্বয়ি বিনেতি ষড়ঙ্গয়া কিং
ভক্তিং জনঃ পরমহংসগতৌ লভেত ॥
৫॥
তৎ–অতএব, তে–আপনাকে, অর্হত্তম –হে পূজ্যতম; নমঃ—সশ্রদ্ধ প্রণাম; স্তুতি কর্ম-পূজাঃ—স্তব আদি ভক্ত্যঙ্গের দ্বারা
আপনার পূজা; কর্ম—আপনাতে অর্পিত কর্ম; স্মৃতিঃ—নিরস্তর স্মরণ; চরণয়োঃ—আপনার শ্রীপাদপদ্মের, শ্রবণম্—সর্বদা শ্রবণ করে; কথায়াম্—আপনার বিষয়ে কথায়, সংসেবয়া—এই প্রকার ভক্তি, ত্বয়ি—আপনাকে; বিনা—ব্যতীত; ইতি—এইভাবে; ষড়ঙ্গয়া—ছয়টি বিভিন্ন অঙ্গ সমন্বিত; কিম্—কিভাবে; ভক্তিম্―ভক্তি; জনঃ —মানুষ পরমহংস গতৌ—পরমহংসগণের লভ্য; লভেত লাভ করতে পারে।
অনুবাদঃ অতএব, হে পূজ্যতম ভগবান,
আপনাকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি, কারণ
স্তব, কর্মফল অর্পণ, পূজা, কর্ম-সমর্পণ, চরণযুগল স্মরণ এবং লীলা শ্রবণ—এই ষড়ঙ্গ সেবা ব্যতীত কে
পরমহংসগণের প্রাপ্য আপনার প্রতি ভক্তি লাভ করতে পারে?
শ্রীনারদ উবাচ
এতাবদ্বর্ণিতগুণো ভক্ত্যা ভক্তেন
নিৰ্গুণঃ ।
প্রহ্লাদং প্ৰণতং প্রীতো
যতমন্যুরভাষত ॥ ৫১ ॥
শ্রীনারদঃ উবাচ—শ্রী নারদ মুনি বললেন; এতাবৎ—এই পর্যন্ত বর্ণিত বর্ণিত, গুণঃ—দিব্য গুণাবলী; ভক্ত্যা-ভক্তি
সহকারে; ভক্তেন–ভক্ত প্রহ্লাদ মহারাজের) দ্বারা; নিৰ্গুণঃ—গুণাতীত ভগবান; প্রহ্লাদম্—প্রহ্লাদ মহারাজকে, প্রণতম্—যিনি ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে
শরণাগত হয়েছিলেন; প্রীতঃ—প্রসন্ন হয়ে; যতমন্যুঃ—তার ক্রোেধ সম্বরণ করে; অভাষত বলেছিলেন।
অনুবাদঃ দেবর্ষি নারদ বললেন—এইভাবে ভক্ত প্রহ্লাদ
মহারাজের অপ্রাকৃত প্রার্থনা শ্রবণ করে ভগবান নৃসিংহদেব তাঁর ক্রোধ সম্বরণ
করেছিলেন, এবং তাঁর শ্রীপাদপদ্মে প্রণত প্রহ্লাদের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাঁকে
বলেছিলেন।
শ্রীভগবানুবাচ
প্রহ্লাদ ভদ্র ভদ্রং তে প্রীতোঽহংতেঽসুরোত্তম।
বরংবৃণীষ্বাভিমতংকামপূরোঽস্মাহংনৃণাম্॥৫২॥
শ্রী ভগবান্ উবাচ—পরমেশ্বর ভগবান বললেন, প্রহ্লাদ–হে প্রিয় প্রহ্লাদ; ভদ্র–তুমি অত্যন্ত স্নিগ্ধ; ভদ্রম্ —সমস্ত সৌভাগ্য; তে–তোমার; প্রীতঃ –প্রসন্ন; অহম্ –আমি (হই); তে–তোমাকে, অসুর-উত্তম—হে অসুর-কুলোদ্ভূত শ্রেষ্ঠ
ভক্ত, বরম্—বর, বৃণীষ্—আমার কাছে প্রার্থনা কর; অভিমতম্—ঈপ্সিত; কাম পূরঃ —যিনি সমস্ত বাসনা পূর্ণ করেন; অস্মি—হই: অহম্ –আমি; নৃণাম্—সমস্ত মানুষের।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে
ভদ্র প্রহ্লাদ, তোমার মঙ্গল হোক। হে অসুরোত্তম, তোমার প্রতি আমি
অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি। আমি সমস্ত মানুষের বাসনা পূর্ণ করি, সুতরাং তুমি আমার কাছে তোমার অভীষ্ট বর প্রার্থনা কর।
মামপ্রীণত আয়ুষ্মন্ দর্শনং দুর্লভং
হি মে ৷
দৃষ্ট্বা মাং ন পুনর্জন্তুরাত্মানং
তপ্তমহতি ॥ ৫৩ ॥
মাম্—আমাকে: অপ্রীণতঃ প্রসন্ন না করে
আয়ুষ্মন—হে দীর্ঘজীবী প্রহ্লাদ।
দর্শনম্–দর্শন করে, দুর্লভম্–অত্যন্ত দুর্লভ, হি —বস্তুতপক্ষে, মে—আমার, দৃষ্ট্বা–দর্শন করে, মাম্ আমাকে ন–না, পুনঃ পুনরায় জীব
আত্মানম্—নিজের জন্য, তপ্তম্-শোক করার
জন্য; অহতি—যোগা।
অনুবাদঃ হে প্রহ্লাদ, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
আমাকে প্রসন্ন না করে কেউই আমাকে জানতে পারে না বা উপলব্ধি করতে পারে না, কিন্তু যে আমাকে দর্শন করেছে অথবা আমাকে প্রসন্ন করেছে, তাকে আর তার নিজের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য শোর করতে হয় না।
প্রীণন্তি হাথ মাং ধীরাঃ সর্বভাবেন
সাধবঃ ।
শ্রেয়স্কামা মহাভাগ সর্বাসামাশিষাং
পতিম্ ॥ ৫৪ ॥
প্রীণন্তি—প্রসন্ন করার চেষ্টা করে; হি—বস্তুতপক্ষে; অথ—এই কারণে, মাম্ আমাকে; ধীরাঃ —যাঁরা ধীর এবং পরম বুদ্ধিমান
সর্ব-ভাবেন—সর্বতোভাবে, ভক্তির বিভিন্ন
উপায়ে সাধবঃ সদাচারী ব্যক্তিগণ (যাঁরা সর্বতোভাবে সিদ্ধ), শ্রেয়স্কামা:
জীবনের শ্রেষ্ঠ লাভের বাসনা করে; মহাভাগ—হে পরম ভাগ্যবান, সর্বাসাম্–সমস্ত: আশিযাম্–আশীর্বাদের; পতিম্ —পতি (আমাকে)।
অনুবাদঃ হে প্ৰহ্লাদ, তুমি মহা ভাগ্যবান।
যাঁরা অত্যন্ত জ্ঞানী এবং উন্নত, তারা সর্বতোভাবে আমার
প্রসন্নতা বিধানের চেষ্টা করেন, কারণ আমিই সকলের সমস্ত বাসনা
পূর্ণ করতে পারি।
শ্রীনারদ উবাচ
এবং প্রলোভ্যমানোহপি বরৈলোকপ্রলোভনৈঃ
।
একাস্তিত্বাদ ভগবতি নৈচ্ছৎ
তানসুরোত্তমঃ ॥ ৫৫ ॥
শ্রীনারদঃ উবাচ—দেবর্ষি নারদ বললেন, এবম্-এইভাবে,
প্রলোভ্যমানঃ প্রলোভিত হয়ে; অপি—যদিও বরৈঃ বরের দ্বারা, লোক-জগতের; প্রলোভনৈঃ—বিভিন্ন প্রকার প্রলোভনের
দ্বারা; একান্তিত্বাৎ—সর্বতোভাবে শরণাগত হওয়ার
ফলে; ভগবতি—পরমেশ্বর ভগবানে; ন ঐচ্ছৎ–তিনি চাননি; তান্—সেই সমস্ত বর; অসুর-উত্তমঃ—অসুর-কুলশ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদ
মহারাজ।
অনুবাদঃ নারদ
মুনি বললেন—প্রহ্লাদ মহারাজ ছিলেন
অসুরকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। অসুরেরা সর্বদা জড় সুখের বাসনা করে। কিন্তু ভগবান
যদিও এই জগতের সমস্ত সুখ ভোগ করার বর প্রদান করে তাঁকে প্রলোভিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শুদ্ধ
কৃষ্ণভক্ত হওয়ার ফলে প্রহ্লাদ মহারাজ তার ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য কোন কিছুই
গ্রহণ করতে চাননি।
কোন মন্তব্য নেই