জড়বন্ধন থেকে মুক্তির উপায়-নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প



 অনেকদিন আগে এক বলবান কাঠুরে এক কাঠের ব্যবসায়ীর কাছে এসে চাকরি চাইল। এমন বলবান কাঠুরে দেখে তো কাঠের ব্যবসায়ী খুবই খুশি। সে তাকে ভালো বেতন ও ভালো কাজের শর্তে চাকরি দিলো। আর মন মতো ভালো চাকরি পেয়ে কাঠুরেও খুব ভালো করে কাজ করার জন্য দৃঢ়সংকল্প হলো। কাঠের ব্যবসায়ী কাঠুরকে একটি কুঠার উপহার দিয়ে তাকে কোথায় কাজ করতে হবে তা দেখিয়ে দিলো। 

কাঠুরে তাঁর কাধে সেই কুঠার নিয়ে কাঠ কাটতে চললো কাঠের ব্যবসায়ীর দেখিয়ে দেওয়া বনে। প্রথম দিনই কাঠুরে আঠারোটি গাছ কেটে আনলো। কাঠের ব্যবসায়ীতো কাঠুরের এ কৃতিত্বে দারুন খুশি। সে কাঠুরেকে বলল- ‘খুব ভালো’ এভাবেই কাজ করে যাও।’ 

মালিকের কথায় উৎসাহিত হয়ে কাঠুরে পরদিনও জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে কঠিন পরিশ্রম করল। ভেবেছিল সে আগের দিনের চেয়ে আরো বেশি গাছ কাটবে। কিন্তু তা হলো না। সেদিন, দ্বিতীয়দিন সে মাত্র পনেরোটি গাছ কাটলো। তৃতীয় দিনও সে কাঠ কাটতে গিয়ে সারাদিন আরো কঠিন পরিশ্রম করলো, কিন্তু সেদিন সে মাত্র দশটি গাছ কাটতে সক্ষম হলো। 

এভাবে যত দিন যায়, ততই তার গাছ কাটার সংখ্যা কমতে লাগলো। অথচ তার পরিশ্রমের কমতি ছিল না। গাছ কাটতে গিয়ে সে কখনো ফাঁকি দেয়নি। কাঠুরে তাই ভেবে পাচ্ছিল না, ব্যাপারটি ঠিক কি ঘটছে! কেন তার কাটা সংখ্যা প্রতিদিন কমে আসছে। সে মনে করলো, নিশ্চয়ই তার শরীরের বল কমে যাচ্ছে। একদিন সে তার মালিক, সেই কাঠের ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলো।

সে কাঠের ব্যবসায়ীকে বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কেন এমন হচ্ছে!” সব শুনে কাঠের ব্যবসায়ী কাঠুরেকে জিজ্ঞেস করলো- “শেষ কবে তুমি তোমার কুঠারটিকে ধার দিয়েছিলে?” প্রশ্নটি শুনে কাঠুরে যেন অবাক হলো। সে বলল- “ধার দেওয়া? না, না। আমার কুঠার ধার দেওয়ার সময় কোথায়? আমি তো গাছ কাটার চেষ্টাতেই সারাদিন ব্যস্ত।

আমাদের জীবনটিও ঠিক এই নৈতিক শিক্ষামূলক গল্পের কাঠুরের মতো। কেননা দেখা যায় যে এজগতে মানুষ যতটাই ব্যস্ত, ততটাই সে অসুখী। সে আরো, আরো সুখী হওয়ার বাসনায় জড় উপকরণ সংগ্রহে সর্সদা ব্যস্ত। তার অন্য কিছু ভাবার সময় নেই। কিন্তু তবুও সে তার আকাঙ্ক্ষিত সুখ লাভ করছে না। এর কারণ কী? এর কারণ হলো, আমরাও আমাদের জীবনরূপ কুঠারটি ধার দেওয়ার কথা বা শান দেওয়ার কথা ভাবি না।

আমরা ভাবি আমাদের ‘সময় নেই’ আর তাই জীবনের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা অবহেলা করি। এই জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কী? আমি কে, সেটি জানা। আমর কেন জন্ম জয়? কেন মৃত্যু হয়? এই মানব জন্মের উদ্দেশ্যটি কী? এই জগৎটি কি মায়ার জগৎ? এখানে সবকিছু অনিত্য তথা চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু আমাদের প্রকৃত স্বরূপে, আমরা হচ্ছি নিত্য। অতএব, নিত্য জীব এই অনিত্য জগতের বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছি। কীভাবে এ বন্ধন থেকে মুক্ত হব? পারমার্থিক জ্ঞান রূপ কুঠার দ্বারা সেই বন্ধন ছেদন করে আমরা এই জড় জগতের দুঃখ- কষ্ট থেকে মুক্ত হতে পারি।

কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞান শুধু একবার জানলেই বা উপলব্ধি করলেই হবে না, যতদিন এ জড়জগতে এই শরীর নিয়ে আমরা অবস্থান করবো, ততদিন আমাদের এ পারমার্থিক জ্ঞান বা কৃষ্ণভাবনামৃতের অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে। এ অনুশীলনই আমাদের পারমার্থিক জ্ঞানরূপ কুঠার ধার দেওয়া বা শান দেওয়ার সমান। এই কুঠারের শান অটুট না থাকলে উপর্যুক্ত গল্পের কাঠুরিয়ার প্রতিদিন গাছের সংখ্যা কমে আসার মতোই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করার পরিমাণও আমাদের ক্রমশ কমে আসবে এবং পরিশেষে পুনরায় মায়ার দ্বারা বিভ্রমিত হয়ে ‘সময় নেই’ রোগে আক্রান্ত হয়ে মায়ার বন্ধনেই আবদ্ধ হয়ে দুঃখ দুর্দশা ভোগ করতে থাকবো। 

তাই আজ থেকেই তোমরা সবাই ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।।” জপ-কীর্তন করলেই মায়ার আক্রমণ থেকে আমরা সুরক্ষিত থাকবো এবং ধীরে ধীরে আমি কে? আমার কর্তব্য কি? এই সমস্ত কিছুই জানতে পারবো। তখন মায়ার বন্ধন ছিন্ন করার জন্য আমাদের জীবনরূপী কুঠারটিও ধারালো হয়ে উঠবে।--হরেকৃষ্ণ--(শ্রীল শচীনন্দন স্বামী

কোন মন্তব্য নেই

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.