কৃপণ এবং ব্রাহ্মণ
নামেমাত্র বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিষয়-ভােগে গা ভাসিয়ে দিলেই তাকে গৃহস্থ বলা যায় না। সেই ধরনের তথাকথিত গহস্থদের | গৃহমেধী বলা হয়। ভক্তরাজ প্রহ্লাদ মহারাজ এই সমস্ত গৃহমেধীদের বর্ণনা করে নিম্নোক্ত শ্লোকটি বলেছেন:
যস্মৈথুনাদি গৃহমেধীসুখং হি তুচ্ছ
কণ্ডয়নেন করগােরিব দুঃখদুঃখম
তৃপ্যন্তি নেই কৃপণা বহুদুঃখভাজঃ
কণ্ডুতিবমনসিজং বিষহেত ধীরঃ
(ভাঃ ৭/৯/৪৫)
এই শ্লোকে যৌনসুখকে গৃহমেধীদের প্রধান সুখ বলে বর্ণনা করা হল। এই সুখ কী রকম? না, চুলকানির মতাে। কারও হাতে যখন চুলকানি হয়, তখন সে চুলকিয়ে এক ধরনের আরাম পায়। কেউ চুলকানি রােগ কামনা করে না। সবাই চুলকানিকে ঘৃণা করে। যার সারা শরীরে চুলকানি, লােকে তার কাপড়-চোপড় পর্যন্ত স্পর্শ করতে ভয় পায় কিংবা ঘৃণা করে।
অতএব এই চুলকানির সুখ শুধু তুচ্ছ সুখ নয়, তা জঘন্যও বটে। কারও হাতে যখন চুলকানি হয়, তখন মাঝে মধ্যেই চুলকানাের জন্য এক রকমের সুড়সুড়ি জাগে। যদি কোনাে ব্যক্তি সেই প্রাথমিক সুড়সুড়িটাকে সহ্য করতে পারে, তা হলে দেখা যায়, তার চুলকানি খুব । অল্প সময়ের মধ্যে সেরে যায় এবং তা শরীরের সর্বত্র ছড়ায় না।
কিন্তু যে ব্যক্তি সেই সুড়সুড়িতে অধীর হয়ে পড়ে, সে তৎক্ষণাৎ চুলকাতে শুরু করে। চুলকানাের সঙ্গে সঙ্গে সে এক ধরনের আরাম পায় এবং সেই আরামের বশবর্তী হয়ে সে তখন আরও চুলকায়। চুলকাতে চুলকাতে যখন রক্ত বেরিয়ে আসে, তখন সে বাধ্য হয়ে চুলকানাে বন্ধ করে। আবার একটা সাময়িক বিরতির পর সে আবার চুলকায়। এইভাবে ঘা ক্রমশ বড় হতে থাকে এবং সারা শরীরে তা ছড়িয়ে পড়ে।
তথাকথিত গৃহস্থরা, যাদের কোনাে চিন্ময় জ্ঞান নেই, তারা আসলে এরকম চুলকানাের আনন্দে মগ্ন। সারা শরীরে দগদগে ঘা হয়ে গেলে | চর্মরােগীর চুলকানি বরং বেড়েই যায়। ঠিক তেমনি অতিরিক্ত যৌন | ভােগের ফলে ভােগবাসনা শুধু বাড়তেই থাকে।
ন জাতু কামঃ কামানাম্
উপভােগেন শামতি
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব
ভূয় এবাভিবর্ধতে
(ভা: ৯/১৯/১৪)
আগুনে ঘি ঢাললে আগুন শুধু বাড়তেই থাকে। জীবনে যে যত বেশি ভােগ করবে, তার ভােগবাসনাও তত বেশি প্রবল হবে। জ্বালানি | বন্ধ করে দিলে আগুন নিভতে বাধ্য। ভােগ বন্ধ হলেই ভােগবাসনা দুর্বল হয়ে পড়বে। আর শুদ্ধ কৃষ্ণভক্তির স্বাদ পেলে, কাম সম্পূর্ণ নির্মূল হবে। কাম তখন প্রেমে রূপান্তরিত হবে।
যে সমস্ত গৃহমেধীরা সেই উন্নত স্বাদের গন্ধটুকুও পায়নি, এই তুচ্ছ সুখকেই তারা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ বলে গণ্য করে। আসলে তা দুঃখ | ছাড়া কিছুই নয়। যারা এই দুঃখজনক চুলকানির সুখে আসক্ত, তারাই কৃপণ, ক্ষুদ্রচেতা। তারা কখনােই তৃপ্ত হয় না। ইন্দ্রিয়ভােগের চর্বিতচর্বণ করে করে তারা অধীর আর উম্মাদ হয়ে ওঠে।
যারা ধীর, তারাই ব্রাহ্মণ। বােকা, কৃপণ এবং মুখদের প্রাপ্য দুঃখকষ্ট কখনােই তাদের ভােগ করতে হয় না। সেই ধরনের ধীর ব্যক্তিই যথার্থ গৃহস্থ। আর অধীর উন্মত্ত, তথাকথিত গৃহস্থরাই গৃহমেধী।
আদর্শ গৃহস্থ জীবন থেকে সংগ্রহীতর্
কোন মন্তব্য নেই