পুরুষোত্তম মাসে করনীয়
স্মার্তগণ পুরুষোত্তম মাস বা অধিমাসকে ‘মলমাস’ বলে এই মাসে সমস্ত শুভকার্য পরিত্যাগ করে থাকেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মাসকে পারমার্থিক মঙ্গলের জন্য অন্য সকল মাস থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে নির্ণয় করেছেন। তিনি নিজের নামানুসারে এই মাসের নাম ‘পুরুষোত্তম’ মাস রেখেছেন। শ্রীবাল্মীকি—দৃঢ়ধন্বা সংবাদে উক্ত আছে,
পুরুষোত্তম মাসস্য দৈবতং পুরুষোত্তমঃ।
তস্মাৎ সম্পজয়েদ্ভক্ত্যা শ্রদ্ধয়া পুরুষোত্তমম্ \
Ñ হে দৃঢ়ধন্বা! পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণই পুরুষোত্তম মাসের অধিদেবতা। অতএব সেই মাসে প্রতিদিন ভক্তিশ্রদ্ধাপূর্বক পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে ষোড়শোপচারে পূজা করবে।
নৈমিষক্ষেত্রে শ্রীসূত গোস্বামী সমবেত ঋষিদেরকে বললেন,
ভারতে জনুরসাদ্য পুরুষোত্তমমূত্তমং।
ন সেবন্তে ন শৃন্বতি গৃহাসক্তা নরাধমাঃ \
গতাগতং ভজন্তেহত্র দুর্ভগা জন্মজন্মনি।
পুত্রমিত্র কলত্রাপ্ত—বিয়োগদ্দুঃখভাগিনঃ \
অস্মিন্মাসে দ্বিজশ্রেষ্ঠা নাসচ্ছাস্ত্রান্যুদাহরেৎ।
ন স্বপ্নেৎ পরশয্যায়াং নালপেৎ বিতথং ক্কচিৎ \
পরপবাদন্ন কথঞ্চিৎ কদাচন।
পরান্নঞ্চ ন ভুঞ্জীত ন কুবীর্ত পরক্রিয়াম্ \
বিত্তশাঠ্যং কুর্বাণোদানং দদ্যাদ্দিজাতয়ে।
বিদ্যমানে ধনে শাঠ্যং কুর্বাণো রৌরবং ব্রজেৎ \
দিনে দিনে দ্বিজেন্দ্রায় দত্ত্বা ভোজনমুত্তমম্।
দিবসস্যাষ্টমে ভাগে ব্রতী ভোজনমাচরেৎ \
ইন্দ্রদ্যুম্নঃ শতদ্যুম্নো যৌবনাশ্বো ভগীরথঃ।
পুরুষোত্তমমারাধ্য যযুর্ভগবদন্তিকম্ \
তস্মাৎ সর্বপ্রযন্তেন সংসেব্যঃ পুরুষোত্তমঃ।
সর্বসাধনতঃ শ্রেষ্ঠঃ সবার্থফলদায়কঃ \
গোবর্দ্ধনধরং বন্দে গোপাল গোপরূপিণম্।
গোকুলোৎসবমীশানং গোবিন্দং গোপীকাপ্রিয়ম্ \
কৌণ্ডিন্যেন পুরাপ্রোক্তমিমং মন্ত্রং পুনঃ পুনঃ।
জপন্মাসং নয়েদ্ভক্ত্যা পুরুষোত্তমমাপ্নুয়াৎ\
ধ্যায়েন্নবঘনশ্যামং দ্বিভুজং মুরলীধরম্।
লসৎপীতপটং রম্যং সরাধং পুরুষোত্তমম্ \
ধ্যায়ং ধ্যায়ং নয়েন্নাসং পূজয়ন পুরুষোত্তমম্।
এবং যাঃ কুরুতে ভক্ত্যা স্বাভীষ্টং সর্বমাপ্নুয়াৎ \
“ভারতভূমিতে জন্মলাভ করে যে গৃহাসক্ত নরাধমগণ শ্রীপুরুষোত্তম ব্রতকথা শ্রবণ ও ব্রত পালন করে না, সেই দুর্ভাগাগণ জন্ম—মরণ এবং পুত্র—মিত্র, কলত্র ও নিজজন বিয়োগজনিত দুঃখভাগী হয়। হে দ্বিজবরগণ! এই পুরুষোত্তম মাসে বৃথা কাব্যালঙ্কারাদি আলোচনা করবে না, পরশয্যায় শয়ন এবং অনিত্য বিষয়ালাপ করবে না; পরনিন্দা, পরান্নভোজন ও পরকার্য করবে না, বিত্তশাঠ্য পরিত্যাগপূর্বক ব্রাহ্মণকে দান করবে। ধন থাকার পরেও বিত্তশাঠ্য করলে রৌরব গমনের কারণ হয়। প্রতিদিন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণদিগকে উত্তম ভোজন দিবে। ব্রতী নিজে দিবসের অষ্টম ভাগে ভোজন করবে। ইন্দ্রদ্যুম্ন, যৌবনাশ্ব ও ভগীরথ প্রমুখ রাজগণ শ্রীপুরুষোত্তমকে আরাধনা করে ভগবৎসামীপ্য লাভ করেছিলেন। সর্বপ্রকার যত্নের সাথে পুরুষোত্তমের সেবা করবে। এই সেবা সকল সাধন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং সর্বার্থফলপ্রদ। ‘গোবর্দ্ধন ধরং’ এই মন্ত্র জপ করে কৌণ্ডীন্য মুনি শ্রীপুরুষোত্তমকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। নবঘন—দ্বিভুজ মুরলীধর, পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধার সাথে নিয়ত ধ্যান করতে হবে। যিনি পুরুষোত্তম মাসে ভক্তিপূর্বক এরূপ করেন, তিনি সর্বাভীষ্ট লাভ করেন।”
পুরুষোত্তম মাসে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানার্থে নানাবিধ ব্রতনিয়ম গ্রহণ করা যেতে পারে। কীভাবে সময়ের সবোর্চ্চ উপযোগ করে ভগবানের সেবা করা যায় সেটাই সংকল্প হওয়া উচিত। তবে সর্বাগ্রে এটা খেয়াল রাখা উচিত যে, নিয়মগুলো (ব্রতের সংকল্প) যেন শুধু লোকদেখানো বা নিয়মাগ্রহ না হয়ে থাকে। ব্রতের সময়সীমা পর্যন্ত যেন সেগুলো পালন করা যায় সেটাও বিবেচনা করতে হবে।
বিভিন্ন রকম নিয়ম গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা-
প্রাতস্নান ও মঙ্গল আরতি
এই মাসে প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তের পূর্বে গাত্রোত্থান করে স্নান ও মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত। এ মাসে এমনকি একবার তীর্থস্নান করলে বারো হাজার বছর ধরে গঙ্গাতে স্নান করার সমান ফল বা বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে প্রবেশ করলে গঙ্গা বা গোদাবরী স্নানে যে ফল লাভ হয়, তা প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে। এ স্নানের ফলে সকল দুঃখ—দুর্দশা দূর হয়।
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ ও কীর্তন
পুরুষোত্তম মাসে প্রতিদিন নির্ধারিত সংখ্যামালার অতিরিক্ত (২৪, ৩২, ৩৩, ৪৮, ৬৪ বা তদূর্ধ্ব) জপ করা উচিত এবং যতবেশি সম্ভব হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করা উচিত।
স্তোত্র পাঠ
প্রতিদিন ‘চৌরাগ্রগণ্য পুরুষাষ্টকম্’, ‘জগন্নাথাষ্টকম্’, ‘নন্দনন্দনাষ্টকম্’, ‘রাধা—কৃষ্ণ কৃপাকটাক্ষস্তোত্রম’ প্রভৃতি নিজাভীষ্ট
স্তোত্রাবলী পাঠ ও পূর্বতন আচার্যকৃত ভজন কীর্তন করা উচিত।
বিশেষ সংখ্যা: ৩৩
এ মাসে ৩৩ সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাধাকৃষ্ণের
উদ্দেশে ৩৩ বার দণ্ডবৎ প্রণাম, ৩৩ সংখ্যক প্রদীপ দান, ৩৩
সংখ্যক ফল ও পুষ্প প্রদান প্রভৃতি যেকোনো সেবায় ৩৩
সংখ্যার ব্যবহার। (পুরাণে বর্ণিত আছে, এ মাসে কৌশিক মুনি ও তাঁর পুত্র মৈত্রেয় মুনি ব্রাহ্মণ গণকে ৩৩ সংখ্যক আপূপ দান করেছিলেন। আপূপ— আতপ চাল, শর্করা ও ঘৃত দ্বারা তৈরি
পিষ্টক বিশেষ)
দীপ দান
পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য প্রতি সন্ধ্যায় ঘৃত প্রদীপ প্রদান করা কর্তব্য। সামর্থ্য থাকলে ঘৃত—প্রদীপ,
নতুবা তিল তৈল—প্রদীপ দেওয়া উচিত।
যোগো জ্ঞানং তথা সাংখ্যং তন্ত্রাণি সকলানপি।
পুরুষোত্তমদীপস্য কলা নার্হন্তি ষোড়শীম্ \
অনুবাদ : অষ্টাঙ্গযোগ, ব্রহ্মজ্ঞান ও সাংখ্যজ্ঞান এবং সমস্ত তান্ত্রিক ক্রিয়া পুরুষোত্তম মাসে দীপ দানের ষোড়শী কলারও তুল্য হয় না।
শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ
এ মাসে প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত ও অন্য সদ্গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করা উচিত। বিশেষ করে শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম স্কন্ধে বর্ণিত ব্রহ্মস্তুতি
ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়।
শ্রীমদ্ভাগবতং ভক্ত্যা শ্রোতব্যং পুরুষোত্তমে।
তৎপুণ্যং বচসা বক্তুং বিধাতা হি ন শক্নুয়াৎ \
পুরুষোত্তম মাসে ভক্তিপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ করবে। ভাগবত শ্রবণের পুণ্য, বিধাতাও বলতে পারে না। ভক্তগণ শ্রীশালগ্রাম শিলার অর্চন করবেন।
হবিষ্যান্ন গ্রহণ
পুরুষোত্তম ব্রতী হবিষ্যান্ন ভোজন করবেন। গম, আতপ চাল, মুগ ডাল, যব, তিল, মটর, কাঙ্গলী তণ্ডুল, উড়ি তণ্ডুল, বেতোশাক, হেলেঞ্চা শাক, আদা, কালশাক, মূলক, কন্দমূল, কাঁকুড়, কলা, সৈন্ধব ও সামুদ্রিক লবণ, দধি, ঘৃত, অনুদ্ধৃত দুগ্ধসার, কাঁঠাল, আম, হরীতকী, পিপ্পল, জিরা, শুঁঠ, তেঁতুল, ক্রমুক, আতা, আমলকী, ইক্ষুজাত চিনি, মিশ্র অতৈলপক্ব ব্যঞ্জনাদি দ্রব্যÑ এ সমস্তই হবিষ্যান্ন।
অন্য নিয়মাবলি
সর্বপ্রকার আমিষ, মৎস্য, মাংস, মধু, কুলকর্কটী ফল, সরিষা এবং সমস্ত মাদকদ্রব্য পরিত্যাগ করবে। ছোলা ডাল, তিল, তৈল, কাঁকরযুক্ত অন্ন, ভাবদুষ্ট—ক্রিয়াদুষ্ট—শব্দদুষ্ট দ্রবসকল পরিত্যাগ করবে। পরান্ন ভোজন, পরদ্রোহ, পরদার গমন পরিত্যাগ করবে। পুরুষোত্তম মাসে দেবতা, বেদ, গুরু, গো, ব্রতী, স্ত্রীলোক, রাজা ও মহাজনের নিন্দা পরিত্যাগ করবে। জন্তুর অঙ্গোদ্ভূত চূর্ণ, আমিষ ও ফলের মধ্যে জম্বীর অর্থাৎ গেঁাড়ালেবু আমিষ। ধান্যের মধ্যে মসুরিকা এবং পর্যুসিত অন্ন আমিষ। ছাগী, গাভী ও মহিষ ব্যতীত অন্য দুগ্ধই আমিষ। ব্রাহ্মণের বিক্রিত সর্বপ্রকার লবণ ও ভূমিজাত লবণ, তা¤্রপাত্রস্থিত গব্য, চর্মস্থিত জল ও নিজের জন্য পাচিত অন্ন আমিষ।
ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ অমৈথুন, অধঃশয্যা, পত্রাবলীতে ভোজন, বিকালে ভোজন পুরুষোত্তম মাসে প্রশস্ত। রজস্বলা, ম্লেচ্ছ, পতিত, ব্রাত্য—ব্যক্তি, দ্বিজদ্বেষী, বেদবাহ্য- এ সকল ব্যক্তির সাথে আলাপ করবে না। এ সকল ব্যক্তির দৃষ্টি এবং কাকদৃষ্ট অন্ন, সূতকান্ন, দ্বিপাচিত অন্ন ও দগ্ধান্ন গ্রহণ করবে না। পেঁয়াজ, রসুন, মুস্তা, ছত্রাক, গাজর, নালিতা, কেমুক— নামক মুলা, শাজনাÑ এ সকল পরিত্যাগ করবে। কার্তিক এবং মাঘেও এসকল নিয়মে ব্রত করবে।
প্রাতঃকালে উঠে পৌর্বাহ্নিকী ক্রিয়া সমাপনপূর্বক শ্রীকৃষ্ণকে ভক্তিপূর্বক হৃদয়ে স্মরণ করে পূর্বোক্ত নিয়মগুলো গ্রহণ করবে।
ব্রত তিন প্রকার- উপবাস, নক্তহবিষা্যন্ন গ্রহণ এবং এক ভোজন। ব্রতীর পক্ষে যেটি কর্তব্য বলে বোধ হয়, তা নিশ্চয় করে এই ব্রত আচরণ করবে।এ মাসে ব্রত শতক্রতু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কেননা ক্রতু (এক প্রকার যজ্ঞ) করে স্বর্গ লাভ হয়। কিন্তু যিনি পুরুষোত্তম ব্রত করেন, তাঁর দেহে সকল তীর্থক্ষেত্র ও দেবতাগণ অবস্থান করেন।
কোন মন্তব্য নেই