ভাগবতের বিশেষ বার্ত্তা
সকল শাস্ত্রের যে কথা, ভাগবতে তো তাহা আছেই। তাছাড়া নিজেহর কথা আছে অভিনব। যে কথা আর কেহ বলেন নাই। ভাগবত শাস্ত্রের প্রধান শ্রোতা কলিহত সংসারী জীব। “সংসারীণাং করুণয়াহ পুরাণ গুহ্যং” - অতি করুণা পরবশ হইয়া বাগবত দুঃখতপ্ত কলিগ্রস্ত সংসারী জীবগণকে বলিতছেন- তোমরা এতদুঃখ ভোগ করিতেছ। উপাসনা করিয়া ব্রহ্ম সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা তোমাদের নাই। আমি আনিয়াছি তোমাদের জন্য নূতন সংবাদ। শোন !
(১) “ভগবান আসেন”
জীব তুমি অক্ষম। তাঁহার কাছে যাইবার শক্তি তোমার নাই। বেদমন্ত্রে আছে, পরম ব্রহ্মের সংবাদ চেষ্টা করিয়া জানা যায় না। তিনি সাধনের অতীত। তাঁহাকে জানা যায় শুধু তাঁহার করুণায়। তিনি প্রসাস সাধ্য নহেন, প্রসাদলভ্য। ইহা জানিয়া পরব্রহ্ম করুণা করিয়া তোমার নিকট আসিয়াছেন। তুমি গোলকে যাইতে অসমর্থ, তাই গোলক বিহারী আসিয়াছেন তোমার জন্য শ্রীবৃন্দাবনে যমুনাতটে। ইহাই ভাগবতের প্রথম বার্ত্তা।
“অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষীং তনুমাশ্রিতঃ”। জগতের প্রতি অশেষ অনুগ্রহ পরায়ণ হইয়া মানুষীতনু ধারন করিয়াছেন শ্রীভগবান। এস, তাঁহাকে দেখিয়া যাও ব্রজে বংশীবটে গোচারণ মাঠে। কতদূরের বস্তু আজ ঘরের হইয়াছেন। তিনি আছেন ইহা প্রাচীন বার্ত্তা। তিনি আসেন ইহা ভাগবতীয় বার্ত্ত।
(২) “ভগবান ডাকেন”
ভাগবত সংবাদ দিয়াছেন- জীব তুমি তাঁহাকে ডাকিতে জান না। তোমার ক্ষীণ কন্ঠের ধ্বনি ত৭াহার গোলকের আসন পর্য্যন্ত পৌঁছায় না। তুমি কি আর ডাকিবে ? কান পাতিয়া শোন। শোন, তিনি তোমাকে আকুল প্রাণে আহ্বান করিতেছেন। তোমা অপেক্ষা সহ¯্রগুণ আর্ত্তি লইয়া তিনি তোমাকে তাঁহার অভিমুখে আকর্ষণ করিতেছেন। আকর্ষণ করেন বলিয়াই তিনি কৃষ্ণ, কেবল মধুরতানে ডাকেন বলিয়া তিনি মুরুলীধর। ত৭াহার বংশী “সর্ব্বভূতমনোহরম্” সকল জীবের মনোহারী, মনপ্রাণ আকর্ষণকারী, ইহাই ভাগবতের দ্বিতীয় বার্ত্তা। তিনি আছেন, তিনি আসেন, তিনি ডাকেন।
(৩) “ভাবনার মধ্যে ভাবনাতীত”
বেদান্ত বলিয়াছেন ব্রহ্মের কথা। কিন্তু কি বলিয়াছেন ? কিছু বলা যায় না- তিনি অশব্দ এই কথাই বলিয়াছেন। তিনি শব্দের অবাচ্য ইহাই শুধু বলা যায়। তিনি অরূপ, অস্পর্শ, অব্যয়। তিনি ইন্দ্রিয়ের অতীত, মনের অতীত, বুদ্ধির অতীত, ধ্যান-ধারণার অতীত। এমনকি আলোচনারও বহির্ভূত বা ঊর্দ্ধেস্থিত। এই ভাবনার অতীতকে লইয়া ভাবনা করিতে সাধারণ জীবের ভয় হয়। চিন্তায় যাঁহাকে নাগাল পাওয়া যায় না, তাঁহাকে চিন্তার গ-ীতে আনিবে কে ? ভাগবত জানাইতেছেন,- জীব ভয় নাই, ভয় নাই, ভাবনার অতীত ধন ভাবনার মধ্যে নামিয়া আসিয়াছেন। ধ্যানের অতীত সত্তা ধ্যানের মধ্য দিয়া ধরা দিয়াছেন। নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিরাকারের ভাষা আমাদের আয়ত্ত নয়, তাহা আমরা পড়িতে জানিনা। অজানা ভাষা আজ জানা ভাষায় অনুদিত হইয়াছে। নির্গুণ, নিরাকার, নির্বিশেষ পরমব্রহ্মের সগুণ-সাকার সবিশেষ অনুবাদই ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ।যিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা, নিখিল জীবের আত্মার আত্মা তিনিই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ব্রজবন্দে নন্দনন্দন, - “কৃষ্ণযেনমবেহিত্বমাত্মানমখিলাত্মনাম্ । জগদ্ধিতায় সোহ্নপ্যত্র দেহী বা ভাতি মায়য়া”॥ শ্রীকৃষ্ণ “গুঢ় কপট মানুষ”। মানুষ, কিন্তু মানুষ নহেন। তিনি পরাৎপর ব্রহ্মের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মানবীয় অনুবাদ। ইহাই ভাগবতের তৃতীয় বার্ত্তা। যিনি চিন্তার অতীত তিনি চিন্তামণি হইয়া ভজনের ধন হইয়াছেন। ব্রহ্মের কথা বলা যায় না। যদি ঈশ্বরের কথা কিছু বলিতে শুনিতে হয়, তবে শ্রীকৃষ্ণের কথাই বলিতে শুনিতে হইবে। শ্রীভগবানের কথা যদি বলিতে শুনিতে হয়, তবে-শ্রীমদ্ভাগবতই ভরসা। অধিকন্তু শ্রীমদ্ভাগবত জীবের দুয়ারে এক নিরুপম সংবাদ, এক পরম করুণার বার্ত্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন পরম বস্তু শ্রীভগবান। তাঁহাকে পাইবার অধিকারী প্রত্যেক নরনারী। কোন যুক্তিতে বলিলেন এই কথা ? ঈশ্বর লাভ করিতে যাহা প্রয়োজন তাহা সকলের আছে কি ? উত্তর এই যে, ঈশ্বর লাভ করিতে একটি মাত্র বস্তু লাগে এবং তাহা সকলেরই আছে। কি সেই বস্তু ? হৃদয়ের সহজ শুদ্ধ ভালবাসা। সহজ শুদ্ধ ভালবাসা কি ? সহজ ভালবাসা বুঝায়, যে ভালবাসা দ্বারা মানুষ মাতাপিতা, স্ত্রী, পুত্রদের ভালবাসে। ইহাই সহজ, সহজাত,- আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম্ম। আত্মার তিনটি ধর্ম্ম - অস্তি, ভাতি ও প্রিয়ত্ব। এই প্রিয়ত্ব ধর্ম্মই ভালবাসা। এই ভালবাসা কৃষ্ণে অর্পিত হইলেই কৃষ্ণ প্রাপ্তি। শুদ্ধভালবাসা বলিতে বুঝায়, যে ভালবাসার মধ্যে স্বার্থপরতা নাই। কোন মতলব বা অভিসন্ধি নাই। যাঁহাকে ভালবাসি তাঁহার সুখ বিধান ছাড়া অন্য বাঞ্ছা নাই। প্রশ্ন হইতে পারে এই শুদ্ধভালবাসা কি সকলের আছে ? উত্তরে বলিব হাঁ আছে। আমাদের ভালবাসার যাহা মালিন্য তাহা ভালবাসার স্বভাব নহে। মালিন্য আগন্তুক, তাহা সরাইয়া দিলেই স্বাভাবিক শুদ্ধতা ভ্যক্ত হইবে। কোন সরোবরের জল যদি মলিন হইয়া অপেয় হইয়া থাকে, তাহা হইলে ফুটাইয়া লওয়া, ডিষ্টিল করা, ফিল্টার করা প্রভৃতি প্রক্রিযার দ্বারা নির্ম্মল করা যায়, পানের যোগ্য করা যায়। কারণ জল স্বভাবতঃ অমলিন। তাহার মালন্য আগন্তুক, তাহা দূর করা যায়। সেইরূপ চিত্তের ভালবাসা শুদ্ধই। মলিন হইয়াছে। ঐ মলিনতা অপসারণ করা যায়। মার্জন করিয়া দূর করা যায়। সাধনার উদ্দেশ্য চিত্তের মার্জনা। মার্জন হয় ভজন। ভজন দ্বারা সুমার্জিত হইলে সকলের হৃদয়ের সহজ ভালবাসা শুদ্ধ হয়। ইহা শ্রীনন্দনন্দনে সমর্পিত হইলেই তৎ প্রাপ্তি। এই বিরাট সত্য ভাগবত শুধু ঘোষনা করেন নাই। শ্রীকৃষ্ণের লীলা জীবনের মদ্যে মূর্ত্ত করিয়া দেখাইয়াছেন। অনন্ত ব্রহ্মা-ের কারণের কারণ লীলা পুরুষোত্তমকে বৃন্দাবনের এক গোয়ালিনী রজ্জু দ্বারা বন্ধন করিয়াছিলেন। ইহা এক অভিনব বার্ত্তা - শ্রীমদ্ভাগবত মহাগ্রন্থের। “ অহং ভক্ত পরাধীনো হ্ন্যস্বতন্ত্র ইব দ্বিজ।” হৃদয়ের সহজ শুদ্ধ ভালবাসার দ্বারা সকলেই খৃস।নধনকে আপনজন করিয়া পারে, অপূর্ব্ব ঘোষনা।
“যেই ভজে সেই বড় অভক্ত হীন ছার।
কৃষ্ণের ভজনে নাহি জাতি কুলাদি বিচার ॥”
তিনি সর্বভূত মনোহর মুরলী বাজাইয়া মুরলীয়া অবিরত ডাকিতেছেন। ভাগবতের এই বার্ত্তা শনিয়া কলিহত জীবের প্রশ্নজাল, কৈ ডাকতো আমরা শুনিতে পাই না।
ভাগবত বলেন, সংসারের কর্ম্ম কোলাহলে তোমাদের কর্ন বধির হইয়াছে। তাই শুনিতে পাও না। এই বধিরতা ঘুচাইবার ঔষধ আছে। মুরলীর ডাক শুনিয়া যাঁহারা উধাও হইয়া ছুটিয়াছেন তাঁহাদের কথা নিত্য শোন। শুনিতে শুনিতে কানের বধিরতা ঘুচিয়া যাইবে। তখন বাঁশীল ডাক শুনিতে পাইবে। বাঁশরী সদাই বাজে। যাঁর কান শোনার যোগ্য হইিয়াছে সেই শোনে। (উপায় কি ?)
হৃদয়ের সহজ শুদ্ধ ভালবাসা কষ্ণে অর্পিত হইলে কৃষ্ণ প্রাপ্তি হইবে। ভাগবতের এই বার্ত্তা শুনিয়া জিজ্ঞাসা জাগে, হৃদয়ের ভালবাসা তো পতি-পত্নী, পুত্র-কন্যা, ধন-ঐশ্বর্য্যরে দিকেই ধায়। কৃষ্ণের দিকে নেবার উপায় কি ? ভাগবত উপায় বলিয়াছেন- যাঁহাদের ভালবাসা কৃষ্ণের দিকেই গিয়াছে তাঁহাদের সঙ্গ কর। দৈহিক সঙ্গ যদি না পার মাসন সঙ্গ কর। মানস সঙ্গ সকলের পক্ষেই সম্ভব। নিত্যনিয়মিত তাঁহাদের কথা শ্রবণ মনন করিলেই মানস সঙ্গ করা হয়। ব্রজে এমন লীলা করিয়াছেন, যাহা শ্রবণ করিলেই চিত্ত তৎপর হইয়া যায়।“ভজতে তাদৃশী ক্রীড়া যা শ্রুত্বা তৎ পরো ভবেৎ,” যাহা শুনিলেই চিত্ত তৎপর হয়, অর্থাৎ কৃষ্ণপর হয়। কৃষ্ণানুপ্রাণিত হয়। ভাগবতী কথা শুধুমাত্র শ্রবণের দ্বারা অশেষ মঙ্গল হয়। “শ্রবণ মঙ্গলম”। সুতরাং ভাগবত শ্রবণ-কীর্ত্তনই জীবের সর্বশ্রেষ্ঠ অথচ সহজতম সাধন। ভাগবতের চরম ও পরম বাঞ্ছিত সুন্দরতমের সংবাদ, তিনি সুন্দরতম।
বেদান্ত দর্শনের শ্রেষ্ঠ সংবাদ হইল-“ব্রহ্মবিদ্ব্রহ্মৈবভবতি”। জীবের মধ্যে এমন যোগ্যতা ঘুমাইয়া আছে যে, সাধনের দ্বারা উন্নতি লাভ করিতে করিতে সে ব্রহ্মভূত হইয়া যাইতে পারে। ইহা এক বিরাট বার্ত্তা। বেদান্তের এই সংবাদ ভাগবতও গাহিয়াছেন। আবার এই বিরাট বার্ত্তা ছাড়া আর একটি অতি সুন্দর সংবাদ ভাগবত পরিবেশন করিয়াছেন, যাহা বেদ বেদান্তে নাই। বিরাট ব্যাপারে আমাদের চক্ষু বিস্ফারিত, আর সুন্দর সংবাদে হৃদয় জুড়াইয়া যায়। বড়কে গ্রহণ করে বুদ্ধিবৃত্তি। সুন্দরকে গ্রহণ গ্রহণ করে হৃদয়বৃত্তি। ভাগবতের সুন্দর সংবাদটি এই যে, তপস্যা দ্বারা মানুষ যেমন ব্রহ্মত্ব লাভ করে, পরব্রহ্মও সেইরূপ তপস্যা দ্বারা মানবত্ব লাভ করেন। মানুষের তপস্যার নাম সাধনা। ঈশ্বরের তপস্যার নাম করুণা। সাধনায় মানুষ উঠে। করুণায় ঈশ্বর নামেন। নামিতে নামিতে ভগবান যখন একেবারে মানুষ হইয়া “মোর পুত্র, মোর সখা, মোর প্রাণপতি” হইয়া যান তখন সুন্দরতম হন তিনি। সুন্দরতম মাধুর্য্যে ভরা। মাধুর্য্যই ভগবত্তা সার। ইহা ভাগবতের পরম বার্ত্তা।
মাধুর্য্য ভগবত্তা সার, ব্রজে কৈল পরচার,
তাহা শুক ব্যাসের নন্দন।
স্থানে স্থানে ভাগবতে, বর্ণিয়াছে নানা মতে,
যাহা শুনি মাতে ভক্তগণ ॥
ভাগবতের সকল সংবাদই ভক্তেরা শোনেন। শ্রদ্ধার সহিত শুনেন। ব্রজের সুন্দরতমের সংবাদ পাইলে তাঁহারা মাতিয়া উঠেন। পাগল হইয়া যান। কারণ সুন্দরতমের মাধুর্য্যময় সংবাদই ভাগবতের অন্তরতম বার্ত্তা। সর্বজীবের অন্তর আলোড়নকারী বার্ত্তা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের চারিটি মাধুর্য্যরে বার্ত্তা দিয়াছেন শ্রীমদ্ভাগবত। বিশ্ব সাহিত্যে এই বার্ত্তা আর কোথাও নাই। রূপমাধুর্য্য, বেণুমাধুর্য্য, প্রেমমাধুর্য্য ও লীলামাধুর্য্য। এই চারিটি মাধুর্য্যে নন্দনন্দন অনন্য সাধারণ। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম যেমন জন্মহীনের জন্ম, দিব্য জন্ম। তাঁহার রূপও যেমন অরূপেররূপ শাশ্বতরূপ। নবকিশোর নটবর। সেইরূপে শুধু জগৎ ভুলে না, আপনার রূপে আপনিও বিমুগ্ধ।
আপন মাধুর্য্যে হরে আপনার মন।
আপনে আপনা চাহে করিতে আস্বাদন ॥
“বেণুমাধুর্য্য”- ভাগবতের প্রতিপাদ্য দেবতা বেণুধর। জগতকে ডাকেন তিনি আপনার অভিমুখে বংশীর তানে। যখন বংশীতে ফুৎকার দেন, তখন অধরের মাধুর্য্য রাশি ছিদ্র পথে ঢালিয়াছেন। উহাই ধ্বনিরূপে পরিণত হইয়া বিশ্বজগৎ ছড়াইয়া যায়।
বংশীছিদ্র আকাশে, তাঁর গুণ শব্দে পৈশে,
ধ্বনিরূপে পায় পরিনাম।
যোগী যোগ ভুলে, মুনি ধ্যান টলে,
ধায় কাননে কামিনী ত্যজি কুলমান ॥
গিরি গোবর্ধ্ধনের শিলা গলে, বেগবতী যমুনা স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রয়। ধেনুর পাল ঊর্দ্ধ পুচ্ঝে ছুটে। নরনারীর চিত্ত কৃষ্ণলালসায় আকুল হইয়া উঠে। আরও কতকি ঘটে।
“প্রেমমাধুর্য্য”- ব্রজের শুদ্ধ ভালবাসার বন্ধনেষড়ৈশ্বর্য্যময় ভগবান সম্পূর্ন আত্মবিস্মৃত। কত বড় কত ছোট হইয়া যান ইহাই প্রেম মাধুর্য্য। যাঁর ভয়ে যম ভীত, তিনি মায়ের ভয়ে ভীত হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে মিথ্যা উক্তি করেন। স্বতন্ত্র পুরুষ হইয়াও শুদ্ধ প্রেমের দুয়ারে সম্পূর্ন অধীন। এই ভক্তাধীনতা বশতঃই ব্রজেন্দ্র নন্দনের এত মধুরিমা। এই প্রেম মাধুর্য্যরে গভীরতা অতলস্পর্শী। লৌকিক সাহিত্যকারেরা প্রধানতঃ কান্তাপ্রেমেরই বিস্তার করিয়াছেন। ভাগবত শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর এই পাঁচ রসেরই আস্বাদন করিয়াছেন। তন্মধ্যে শ্রীবৃন্দাবনে বাৎসল্য, সখ্য ও মধুর এই তিন রসের যে ভিয়ান করিয়াছেন ভাগবত শাস্ত্র, নিখিল বিশ্ব সাহিত্যে ইহার জুড়ি নাই। শ্রীভগবান ভক্তহৃদয়ের প্রেম মাধুর্য্যরে ভোক্তা। তাই শ্রীভাগবত অশেষ বিশেষে প্রেমরসের যত প্রকার বৈচিত্র হইতে পারে তাহা প্রপঞ্চিত করিয়াছেন।
“লীলামাধুর্য্য”- লীলাময় শ্রীহরির লীলায় ঐশ্বর্য্য ও মাধুর্য্য দুইটি বস্তু আছে। ঐশ্বর্য্যে তাঁহার মহত্ব ও মাধুর্য্যে তাঁহার প্রিয়ত্বের প্রকাশ। দুই মিলিয়া এক অনির্বচনীয় মধুরিমা। পূতনাকে বধ করিয়াছেন স্তন্য পান করিতে করিতে। পূতনা বধে ঐশ্বর্য্য। স্তন্যপানে মাধুর্য্য। দুই এর মিলনটি চমৎকার। নাচিতে নাচিতে কালীয় নাগের ফণাগুলি ভাঙ্গিয়া দিয়া তাহাকে দমন করিয়াছেন। কালীয় দমন ঐশ্বর্য্য। মধুর নৃত্যে অপূর্ব্ব মাধুর্য্য। দুয়ের মিলন অভিনব চিত্তচমৎকারী। ব্রজে এই লীলা মাধুর্য্য অপরিসীম মধুরিমা ম-িত। ইহার বর্ননায় শ্রীমদ্ভাগবতের নৈপুণ্য স্মিয়কর। এই চারি মাধুর্য্যে মধুময় শ্যামসুন্দর সুন্দরতম। এই সুন্দরতমকে আপনজন করিয়া লইবার সহজ উপায় হৃদয়ের সর্বাপেক্ষা সুন্দরতম বস্তু যে ভালবাসা, তাহা নিঃশেষে শ্রীকৃষ্ণে সমর্পন করা। এই ভালবাসা আছে সকল জীবের বুকের তলে। সুতরাং জাতি-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল নরনারীই সুন্দরতমকে হৃদয় সর্বস্ব করিয়া লইতে অধিকারী। শ্রবণমন রসায়ন মধুময় ভাষায় শ্রীমদ্ ভাগবত এই অতুলনীয় বার্ত্তা, উদ্ ঘোষনা করিয়াছেন কলিতাপহত জীব নিবহের গোচরে। ভাগবতের যাহা অভিনব বার্ত্তা তাহা সংক্ষেপে কিছু বলা হইল। এইবার ভাগবতের বৈশিষ্ট্যের কথা কিছু বলিব।
ভাগবতের বৈশিষ্ট্য-“শ্রবণ মঙ্গলম্”
ভাগবত শাস্ত্র শ্রবণ করিলেই কল্যাণোদয় হয় - ইহা এই শাস্ত্রের এক অপূর্ব্ব বিশেষত্ব। অন্যান্র শাস্ত্র কথা শুনিয়া কার্য্যতঃ কিছু করিতে হয়। সদা সত্য কথা বলিবে। উপদেশ শুনিয়া সত্য কথা বলিতে হয়। না হইলে উপদেশ শোনা প্রায় ব্যর্থ হইয়া থাকে। ভাগবত কথা কিন্তু শ্রবণ করিলেই মঙ্গল হয়। ইহার কারণ এই যে, অন্যান্য শাস্ত্রে আছে ইতি কর্তব্যতা, ইহা করা উচিত, ইহা করা অনুচিত- এই কর্ত্তব্যের উপদেশ। এই উপদেশ মত জীবন চালাইলেই কল্যাণ হয়। শুধু জানা মাত্র কোন লাভ হয় না। ভাগবত শাস্ত্র উপদেশ প্রধান নহে। কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যের নিদ্দেশই ভাগবতের একমাত্র কার্য্য নহে। জীবের নিকট একটি েিশষ বার্ত্তা পরিবেশন করাই ভগবানের মূল উদ্দেশ্য। সেই বার্ত্তা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। ভগবান প্রেমের ঠাকুর, তাঁহাকে ভালবাসায় পাওয়া যায়। তিনি আসেন জীবের ঘরে, ডাকেন বড় মধুর স্বরে। তিনি অনাদি কালের নিজজন এই সংবাদটি অন্তর দিয়া গ্রহণ করিলেই মঙ্গল আসিবে। অনাদি কালের সুহৃদকে ভুলিয়া গিয়াছি। কোন সংবাদ শুনিয়া তাঁহার কথা মনে জাগিলেই বিস্মৃত সৌহার্দ্দ সজাগ হইয়া উঠে। ইহাতেই চরম মঙ্গলের উদয়।
লৌকিক সাহিত্যের উপজীব্য মানুষ ও তার ভালবাসা। মানুষে মানুষে প্রীতির মিলন, আনন্দ ও বিরহের বেদনা ও ইহাদের বিবিধ বিচিত্রতা লইয়াই লৌকিক কাব্যগ্রন্থ। ভাগবতের মুখ্য আলোচ্য বিষয় প্রেম-প্রীতির মিলন, বিরহ ও তাহার অশেষ প্রকার বৈচিত্র্য। পার্থক্য এই যে, লৌকিক সাহিত্যের মানুষ সত্য সত্যই মরজগতের মানুষ ও তাহাদের ভালবাসা নশ্বর ব্যক্তিদের নশিশীল আকর্ষণ। পক্ষান্তরে ভাগবতের মানুষ গূঢ় কপট মানুষ। মানুষরূপে পরব্রহ্ম। আর ভাগবতের ভালবাসা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার। ভাগবতের প্রেম ভক্তসঙ্গে ভগবানের শাশ্বত ভাব-বন্ধন। ভগবান যেন খাঁটি সোনা। লৌকিক সাহিত্য যেন গিল্টি করা কোন ধাতু। আপাতঃ দৃষ্টিতে দুইই সমুজ্জ্বল। গভীর দৃষ্টিতে একটি বস্তু অমৃতময়। অপরটি বিষয় মরণ ধর্ম্মী। শ্রীভাগবতের মধ্যে আগাগোড়া একটা ভক্তির প্রবাহ। লৌকিক সাহিত্যে কোথাও তাহা নাই। বরং তদ্ বিপরীত। উহা পড়িতে পড়িতে ভোগলালসা উদ্দীপিত হইয়া উঠে। আর শ্রীমদ্ভাগবত পড়িতে পড়িতে হরিভক্তি রসমাধুর্য্যে অন্তর ভরিয়া যায়। গীতা ও ভাগবতে দুইই গুরু-শিষ্য সংবাদ। গীতার বক্তা গুরু, জগদ্ গুরু শ্রীকৃষ্ণ। আর ভাগবতের বক্তা গুরু ভক্তশিরোমণি শ্রীশুকদেব। গীতায় ভগবান নিজের কথা নিজে বলায় সকল বলা সম্ভব হয় নাই। শ্রীভগবান নিজে যে কত সুন্দর, কত মধুর, কত যে প্রেমের আস্বাদন এইসব কথা নিজে বলিতে পারেন না। নিজের এইসব কথা নিজে ভাল করিয়া জানেন না, বলেন না, বলিতে পারেন না। বলিলেও তাহা রসাবহ হয় না। শ্রীভাগবতের বক্তা ভক্ত, তাই ঐসকল মাধুর্য্যরে কথা অতীব মনোহারীভাবে বর্ণিত হইয়াছে। ভগবদ্ভক্তির বস্তুটি আসলে ভক্তেরই সম্পদ। ভগবানের নয়। পিতৃভক্তি পুত্রের হৃদয়ে থাকে, পতিপ্রেম পত্নীর হৃদয়ে থাকে। সেইরূপ ভগবত বস্তুটি ভক্তজনের হৃদয়েই প্রবাহিত থাকে। এইহেতু ভক্তি প্রেমের কথা ভক্তমুখেই অধিকতর মাধুর্য্য ম-িত হয়। তত্ত্বকথা আলোচনায় ভগবানকে কেহ ছাড়াইতে পারে না। এই জন্য গীতার তত্ত্বকথা আর ভাগবতের তত্ত্বকথা অভিন্নই। গীতায় যে সকল সাধক ভক্তের লক্ষণ বলা আছে, ভাগবতে তাঁহাদের মূর্ত্তি দেখাইয়া দিয়াছে। যেমন গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তি যোগের ভক্তের লক্ষণ সকলই ভাগবতের শ্রীপ্রহ্লাদ চরিত্রে পরিস্ফুট হইয়াছে। গীতার “সর্ব্ব ধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য” এই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র ভাগবতের রাসলীলার অভিসারে জীবন্ত হইয়াছে। গীতার চরম পরমতত্ত্ব “পুরুষোত্তম” এই তত্ত্বটি গীতা অতি সুন্দরভাবেই বলিয়াছেন। কিন্তু পুরুষোত্তমের লীলারসের মাধুর্য্যটি ভাগবতই উপচাইয়া ঢালিয়া দিয়াছেন। গীতা ভাগবত দুইই পুরুষোত্তমবাদী। গীতার দৃষ্টি তাঁর তত্ত্বের দিকে। তত্ত্বকে গ্রহণ করে যুক্তি। সুতরাং গীতা যুক্তি প্রধান। বাগবতের দৃষ্টি রসের দিকে। রসকে গ্রহণ করে চিত্তের ভাব। সুতরাং ভাগবত ভাব প্রধান। তত্ত্ব ও রস কথা দুইটি কি, তাহা একটু বিশেষ ভাবে আলোচনীয়। যেমন- সন্দেশ একটি সুখাদ্য বস্তু। ইহার মধ্যে কি কি উপাদান, কি ভাবে কি ক্রম অনুসারে তাহাদের সংমিশ্রণ, প্রস্তুত করিবার প্রণালী কি,- এই সকল আলোচনাকে বলা যায় সন্দেশের তত্ত্বালোচনা। আর রসনার সঙ্গে সন্দেশের মিলন ঘটিলে যে একটি অনির্ব্বচনীয় সুখানুভূতি হয় তাহার স্বরূপ ও বৈচিত্র্যের আলোচনাকে বলা যায় রসালোচনা। পরমতম ব্রহ্মবস্তুর তত্ত্বালোচনায় উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র, গীতা ও ভাগবত সকলেই এই পথের পথিক। কিন্তু রসের বিন্যাসে, বিস্তারে ও আস্বাদনে শ্রীবাগবত সকল শাস্ত্রের শিরোমনি, ভাগবত শাস্ত্র চক্রবর্ত্তী। আচার্য্যপাদ্যান উপনিষদকে বলিয়াছেন শ্রুতি প্রস্থান। ব্রহ্মসূত্রের নাম দিয়াছেন ন্যায় প্রস্থান। ভগবদ্ গীতার নাম দিয়াছেন স্মৃতি প্রস্থান। এই দৃষ্টিকোন হইতে শ্রীমদ্ভাগবতের প্রকৃষ্ট স্বরূপ পরিচয় হইতে পারে রস প্রস্থান। শ্রুতিতে “রস বৈ সঃ” মন্ত্রে যাঁহার স্বরূপের সন্ধান, মধুব্রহ্ম, আনন্দব্রহ্ম নামে যাঁহার পরিচয়, ভাগবত তাঁহারই নিরূপণে রসলীলার কথা বলিয়াছেন। কৃষ্ণলীলার মধ্যে ঐ রস, ঐ মধু, ঐ আনন্দ অলৌকিকরূপে আস্বাদিত হইয়াছে। অতএব ইহা রসিক ও ভাবুকের আস্বাদনীয়। যাঁহারা সাহিত্য রসের মর্মজ্ঞ তাঁহারা রসিক। যাঁহারা দর্শন তত্ত্বজ্ঞ তাঁহারা ভাবুক। রসিকেরা শুষ্ক দর্শনতত্ত্ব আস্বাদন করেন না। পক্ষান্তরে দর্শনজ্ঞেরা সাহিত্য রসকে উপেক্ষা করেন। কিন্তু ভাগবত রশিক ও ভাবুক উভয়ের আস্বাদ্য বস্তু। ভাগবত শ্রীবগবানকে করিয়াছেন সহজ সুন্দর মানুষ, আর তাঁহার প্রাপ্তির উপায় দিয়াছেন নির্ম্মল ভালবাসা। মানুষ আর ভালবাসা এই দুইটি বস্তু হইল লৌকিক সাহিত্যের উপাদান। এইজন্য পুরাণ শিরোমণি সর্ব্ববেদান্ত সার ভাগবত হইয়াছেন এক অপূর্ব্ব সাহিত্য। যুগ যুগ ধরিয়া কতশত কাব্যনমাদীর রসের উপাদান জোগাইয়াছেন ভাগবত। ্¦ার ভাগবতের লক্ষ্য বস্তু পরমব্রহ্ম ভগবান। এই শাশ্বত তত্ত্বের আলোচনায় এই গ্রন্থ হইয়াছেন দর্শন গ্রন্থ। এই জন্য ভাগবত রসিক ও ভাবুক উভয়ের আস্বাদ্য বস্তু। এইরূপ গ্রন্থ আর দ্বিতীয় নাই। দর্শনতত্ত্ব ও কাব্যরসের মিলিত মাধুর্য্য ভাগবতে প্রবাহিত। তাই প্রারম্ভেই ভগবানের আহ্বান - “ পিবত ভাগবতংরসমালয়ং মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ” । হরি ওঁ ॥
কোন মন্তব্য নেই